আগে সিম কার্ড বলতে আমরা বুঝতাম চারকোনা আকৃতির একটি ছোট্ট ও শক্ত কার্ড যেটি ফোনে ইনসার্ট করে আমরা কারো সাথে কথা বলতে পারি, মেসেজিং করতে পারি আবার ইন্টারনেটে ব্রাউজও করতে পারি। তবে এখন সময় বদলেছে। সময় বদলের সাথে সাথে সিম কার্ডের ধরনেরও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। সাধারণ সিমের পাশাপাশি এখন প্রচলন হয়েছে ই সিম এর। তবে অনেকেই কিন্তু এখনও ই সিম কি ,ই সিম ব্যবহার করার নিয়ম ,ই সিমের সুবিধা ও অসুবিধা ইত্যাদি সম্পর্কে জানেন না। তাই আজকের লেখায় আপনাদেরকে জানাবো ই সিম সম্পর্কে বিস্তারিত। তার পাশাপাশি আপনারা জানতে পারবেন গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক ই সিম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। তাহলে চলুন আর দেরি না করে শুরু করা যাক।
সিম কার্ড কি?
ই সিম কি কিংবা ই সিম ব্যবহার করার নিয়ম সম্পর্কে তো জানাবোই, তার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক সাধারণ সিম কার্ড বলতে কি বোঝানো হয়। খুব সহজ করে বলতে গেলে সাধারণ সিমকার্ড হচ্ছে চারকোনা আকৃতির একটি কার্ড। এই কার্ডটি সোনালী রঙের সার্কিট বিশিষ্ট। এই সোনালী সার্কিটটিই মূলত সিম কার্ডের মাদারবোর্ড, যার মাধ্যমে এটিতে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কন্টাক্ট নাম্বারগুলো খুব সহজেই সেভ করে রাখতে পারি। প্রতিটি সিমকার্ডের নম্বরই ইউনিক, অর্থাৎ একটি সিমকার্ডের সাথে অন্য সিম কার্ডের নম্বর কখনোই মেলেনা।
যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা সিমকার্ড ক্রয় করতে পারি সেগুলোকে সিম কার্ড অপারেটর বলা হয়। কয়েকটি জনপ্রিয় সিম কার্ড অপারেটরের নাম হলো গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক টেলিটক ইত্যাদি। সাধারণত প্রতিটি অপারেটরের সিমকার্ডের প্রথম তিনটি ডিজিট ইউনিক হয়ে থাকে যেগুলোর মাধ্যমে কোন সিম কার্ড কোন অপারেটরের সেটি চিহ্নিত করা যায়। যেমনঃ গ্রামীণফোন সিমের নম্বর ০১৭ দিয়ে শুরু হয় ,আবার টেলিটক সিমের নম্বর ০১৫ দিয়ে শুরু হয়।
এই সিম কার্ডগুলো এমন ভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে এগুলো সাধারণ বাটন ফোন থেকে শুরু করে স্মার্টফোন কিংবা যেসব ট্যাবলেট ডিভাইসে এই সিম কার্ড সাপোর্ট করে সেগুলোতোও ব্যবহার করা যায়। আগেকার দিনে সিম কার্ড কেনা বেশ সহজ হলেও এখন যদি আপনি কোন কোম্পানি থেকে সিম কিনতে চান, তাহলে আপনাকে ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়ে এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেয়ার মাধ্যমে সিম ক্রয় করতে হবে।
ই সিম কি?
চলুন এবার জেনে নেয়া যাক ই সিম কি। ই সিমকে সাধারণভাবে ভার্চুয়াল সিম নামে ডাকা হয়। কারণ সাধারণ সিমকার্ডের মতো এই সিমের কোন বাহ্যিক আকৃতি নেই এবং এজন্যে এটির কোন ওজনও অনুভব করা যায় না। সুতরাং এই সিমকে সাধারণ সিম কার্ডের ডিজিটাল ভার্শন নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। ই সিমের সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা বরং একটু পরে জানব।
এখন আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন যে সিম কার্ড আপনারা দেখতেই পাবেননা সেটি কিভাবে নিজেদের ফোনে ইনসার্ট করবেন। আসলে এই সিম কার্ড ইনসার্ট করার জন্য ফোনে কোন সিমকার্ডের ট্রে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং কয়েকটি সহজ স্টেপ ফলো করার মাধ্যমে আপনারা আপনাদের স্মার্টফোনের বিল্ট ইন চিপসেটে ই সিম ইন্সটল করে সেটি ব্যবহার করতে পারবেন। এই একেকটি চিপসেটে আপনারা একাধিক অপারেটরের সিম ইউজ করার দারুণ সুবিধাটিও পেয়ে যাবেন।
অনেকেই মনে করেন, যেহেতু ই সিম একটি ডিজিটাল সিম, তাই এটি ব্যবহার করা হয়তো সেফ নয়। তাদের জন্য বলছি, প্রতিটি ই সিমের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ই সিম সাপোর্ট করে এমন স্মার্টফোনগুলোতে eUICC নামক একটি ডেডিকেটেড চিপসেট দেয়া থাকে। এই চিপসেটই কোনো হার্ডওয়্যারের বাড়তি ঝক্কি ছাড়াই ই সিমকে করে তোলে শতভাগ নিরাপদ।
এই ধরনের সিম ইনস্টল করার জন্য সিম অপারেটরের আউটলেটে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট কিউআর কোড নিজের ফোনের ক্যামেরা দিয়ে স্ক্যান করতে হয়। তারপর সিম ইনস্টল হয়ে গেলে সেটি দিয়ে সাধারণ সিমকার্ডের মতোই সব কাজ যেমন কল, মেসেজিং কিংবা ইন্টারনেট ব্রাউজিং করা যায়। আশা করি এবার ই সিম কি সেটি আপনারা ভালোমতো বুঝতে পেরেছেন।
জেনে রাখা ভালো, ই সিম ইনস্টল করার এই একেকটি কিউআর কোড একজন ইউজার মাত্র একবারই স্ক্যান করতে পারবেন। অর্থাৎ চাইলেও কেউ ই সিম ক্লোনিংয়ের মতো অপরাধ করতে পারবেনা। শুধু তাই নয়, ই সিমে থাকা প্রতিটি ডেটার সর্বোচ্চ সিকিউরিটি নিশ্চিত করা হয়।
কোন কোন ফোনে ই সিম ব্যবহার করা যায়?
যেহেতু ই সিম কিংবা ভার্চুয়াল সিম তথ্যপ্রযুক্তির একটি নতুন আবিষ্কার, একারণে এখনও সব ফোনে এই সিম ব্যবহার করার সুযোগ নেই। বর্তমানে তিনটি ব্র্যান্ডের স্মার্টফোনে ই সিম ব্যবহার করা যায়। সেগুলো হল অ্যাপল, স্যামসাং এবং গুগল পিক্সেল। চলুন জেনে নেয়া যাক কয়েকটি ফোনের মডেল সম্পর্কে যেন আপনারা ই সিম ব্যবহার করার নিয়ম জেনে এসব স্মার্টফোনে সিমটি ব্যবহার করতে পারেন।
অ্যাপলঃ
আইফোন ১১, ১১ প্রো, ১১ প্রো ম্যাক্স , আইফোন ১২, ১২ মিনি , ১২ প্রো, ১২ প্রো ম্যাক্স, আইফোন ১৩, ১৩ মিনি, ১৩ প্রো, ১৩ প্রো ম্যাক্স, আইফোন এক্স আর, আইফোন এস ই ইত্যাদি। এর পাশাপাশি আইপ্যাড প্রো ও আইপ্যাড এয়ারের কয়েকটি মডেলও ই সিম সাপোর্ট করে। যেমনঃ আইপ্যাড প্রো ১২.৯ ইঞ্চি থার্ড ও ফোর্থ জেনারেশন, আইপ্যাড এয়ার থার্ড ও ফোর্থ জেনারেশন ইত্যাদি।
স্যামসাংঃ
স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ২০, গ্যালাক্সি নোট ২০, গ্যালাক্সি জেড ফোল্ড ট্যু ফাইভ জি, গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ ফাইভ জি, গ্যালাক্সি এস ২২ ফাইভ জি ইত্যাদি।
গুগল পিক্সেলঃ
পিক্সেল ২, পিক্সেল ৩, পিক্সেল ৩ এক্স এল, পিক্সেল ৪, পিক্সেল ৪ এ, পিক্সেল ৫, পিক্সেল ৫ এ ফাইভ জি, পিক্সেল ৬ ইত্যাদি।
ই সিম ব্যবহার করার নিয়ম
ই সিম কি এবং কোন কোন ফোনে এটি ব্যবহার করা যায় সেটি তো জেনে ফেললেন, তাহলে এবার চলুন ই সিম ব্যবহার করার নিয়ম জেনে আসি।
গ্রামীণফোন ই সিম
২০২২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের বাজারে সর্বপ্রথম ই সিম লঞ্চ করে গ্রামীণফোন। যদি আপনি আপনার ফোনে এই অপারেটরের ই সিম ব্যবহার করতে চান, তাহলে আপনাকে সরাসরি চলে যেতে হবে আপনার নিকটস্থ গ্রামীণফোন সেন্টারে।
জেনে রাখা ভালো প্রিপেইড ও পোস্টপেইড দুই ধরনের সংযোগেই ক্ষেত্রে আপনারা ই সিম ব্যবহার করতে পারবেন। তাই গ্রামীণফোন সেন্টারে গেলে শুরুতেই আপনাকে ডিসাইড করতে হবে আপনি প্রিপেইড নাকি পোস্টপেইডের সিম ব্যবহার করবেন। তারপর আপনাকে নিজের মোবাইল নাম্বার চুজ করতে বলা হবে। তারপর বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন কমপ্লিট করলে তারা আপনাকে একটি কিউআর কোড সম্বলিত কাগজ প্রোভাইড করবে, যেটি স্ক্যান করার মাধ্যমে এই সিমটি আপনার ফোনে ইন্সটল করে নিতে হবে।
আপনারা চাইলে আপনাদের রেগুলার সিম কার্ডটিও ই সিমে কনভার্ট করে নিতে পারেন। আবার যদি ই সিম ব্যবহার করা কমফোর্টেবল মনে না হয়, সেক্ষেত্রে আপনার ই সিমটি কিন্তু রেগুলার সিমেও কনভার্ট করা সুযোগ থাকছে।
আপনি যদি নতুন ই সিম পারচেজ করতে চান, তাহলে আপনাকে ২০০ টাকা খরচ করতে হবে। আর যদি সাধারণ সিম কার্ড থেকে ই সিমে কনভার্ট করতে চান, সেক্ষেত্রে খরচ হবে মাত্র ৯৯ টাকা।
বাংলালিংক ই সিম
আগে শুধুমাত্র গ্রামীণফোনের গ্রাহকদেরই ই সিম ব্যবহার করার সুযোগ ছিল, তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের ২২ তারিখ থেকে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকও গ্রাহকদের জন্য ই সিম সুবিধা চালু করেছে।
যদি আপনারা বাংলালিংকের ই সিম ক্রয় করতে চান, তাহলে আপনাদেরকে যেকোনো বাংলালিংক সার্ভিস সেন্টারে যেতে হবে এবং উপরে উল্লেখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ই সিম ক্রয় করতে হবে। বাংলালিংকের ক্ষেত্রেও আপনারা ফিজিক্যাল সিম থেকে ই সিম কিংবা ই সিম থেকে ফিজিকাল সিমে কনভার্ট করতে পারবেন।
Read More:
ই সিমের সুবিধা ও অসুবিধা
এবার আসা যাক আজকের লেখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশে। চলুন জেনে নেয়া যাক ই সিমের সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত।
ই সিমের সুবিধা
ই সিমের সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে ই সিম ব্যবহার করলে আপনারা একটি স্মার্টফোনে একাধিক অপারেটরের সিম ইউজ করতে পারবেন। সর্বশেষ হিসাব মতে একটি ই সিম ব্যবহার করলে পাঁচটি অপারেটরের সিমের যাবতীয় ডেটা আপনারা নিজেদের স্মার্টফোনে সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন। তাই যাদের বিভিন্ন কাজে একাধিক সিম কার্ড ইউজ করতে হয়, তাদের জন্য ই সিম হতে পারে একটি ভালো অপশন। এর পাশাপাশি ই সিমের সিকিউরিটিও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তাই যারা নতুন একটি এক্সপেরিয়েন্স ট্রাই করতে চান, তারা একবার নিজেদের রেগুলার সিম ই সিমে কনভার্ট করে দেখতে পারেন।
ই সিমের আরেকটি সুবিধা হলো সাধারণ সিমকার্ডের মত পানি, ধুলো কিংবা কাদাতে এই সিম নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোনো চান্স নেই। এই বিশেষ ধরণের সিমকে সবাই পরিবেশ বান্ধব হিসেবেও দাবি করে থাকেন। কেননা এই সিম তৈরিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপাদান প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় না।
ই সিমের অসুবিধা
ই সিমের একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে যেসব ফোন ই সিম সাপোর্ট করে, সেগুলোর মূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তাই যদি এসব মডেলের ফোন আপনার কাছে না থাকে, তাহলে আপনি চাইলেও এই সিম ব্যবহার করতে পারবেন না।
এছাড়াও যদি কোন কারণে আপনার ফোন নষ্ট হয়ে যায়, হারিয়ে যায় কিংবা ফোন ফ্যাক্টরি রিসেট করতে হয়, তাহলে ফোনে এই সিমের যত ডেটা রয়েছে সব ইরেজ হয়ে যাবে এবং সেগুলো আপনি আর রিকভার করতে পারবেন না। তখন দেখা যাবে আপনি আপনার গুরুত্বপূর্ণ কন্টাক্ট নাম্বার গুলোই হারিয়ে ফেলেছেন।
শেষ কথা
এটুকুই ছিল ই সিম কি নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। আশা করছি আপনারা আজকের লেখা থেকে ই সিম কি, ই সিম ব্যবহার করার নিয়ম এবং ই সিমের সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। এমন আরও আর্টিকেল পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন।
আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজ থেকে