জীবনে চলার পথে নগদ অর্থের কতটুকু প্রয়োজন সেটা তো সবাই জানেন। বলুন তো এই নগদ অর্থ কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের হাতে পৌঁছে যায়? ঠিক ধরেছেন, আমি ব্যাংকের কথা বলছি৷ প্রতিটি দেশেই নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় কার্যাবলি সম্পন্ন করতে যে অর্থ বা মুদ্রার প্রয়োজন হয়, সেগুলো প্রণয়ন করা হয় ব্যাংকের মাধ্যমে।কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, যদি এমন হতো অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে আপনি কোন কিছু কিনছেন ঠিকই, কিন্তু সেই অর্থের উৎস কোনো ব্যাংক নয় এবং সেই অর্থের উৎস সম্পূর্ণই ডিজিটালাইজড। অবাক হয়ে গেলেন? আসলে এক যুগ আগেও কেউ এমন ধরণের লেনদেন যে হওয়া সম্ভব সেটি ভাবতেও পারেনি৷ কিন্তু এখন বিটকয়েনের মাধ্যমে সেটি সম্ভব হয়েছে। বিটকয়েনের লেনদেনের মাধ্যমে অনেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও হচ্ছেন৷ তাই বিটকয়েন নিয়ে এই প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহের কোনো কমতি নেই৷ তবে অনেকেই রয়েছেন যারা বিটকয়েন কি সেটি না জেনেই লাভের আশায় এটি কেনার চেষ্টা করেন যা কখনোই উচিৎ নয়৷ আজকের লেখায় আমি বিটকয়েন কি, বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে এবং বিটকয়েন থেকে বিকাশের লেনদেন সম্ভব কিনা এই তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। তাই যারা বিটকয়েন নিয়ে জানতে চান তারা অনুগ্রহ করে লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন বলে অনুরোধ করছি৷
বিটকয়েন কি?
বিটকয়েন কি সেটি জানতে হলে আপনাদের সবার আগে জানতে হবে ক্রিপটোকারেন্সি কাকে বলে। ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এমন এক ধরণের কারেন্সি।
ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল বৈশিষ্ট্য হলো –
- এটি কোন দেশের সরকার বা ব্যাংকের মাধ্যমে তৈরিকৃত কারেন্সি নয়। এটি ব্লকচেইন নামক এক ধরণের বিশেষ নেটওয়ার্কিং টেকনোলজির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জটিল অ্যালগোরিদম, ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং ব্লকের সমন্বয়ের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।
- ক্রিপটোকারেন্সির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এটির মাধ্যমে লেনদেন করার জন্য বেছে নেয়া হয় অনলাইন নেটওয়ার্ক। একারণে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় বসে এই কারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন করা সম্ভব।
এবার বলি বিটকয়েন কি। বিটকয়েন হলো এক প্রকার ক্রিপ্টোকারেন্সি। প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসেবে বিটকয়েনের যাত্রা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে থেকে। ২০০৮ সালে অনলাইনভিত্তিক একটি পেপারে সাতোশি নাকামোতো নামের একজন অজ্ঞাত লোক বা একটি অজ্ঞাত দলের করা পোস্টের মাধ্যমে বিটকয়েন সবার নজরে আসে এবং ২০০৯ সাল থেকে এর মাধ্যমে লেনদেন শুরু হয়। সোজা বাংলায় বিটকয়েনের অর্থ হচ্ছে এটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া এক ধরণের ডিজিটাল মুদ্রা। যেহেতু বিটকয়েন কোনো দেশের রাষ্ট্র তৈরি করেনা, তাই এর মাধ্যমে পুরো পৃথিবীজুড়ে অনলাইনে পিয়ার টু পিয়ার ট্রানজেকশন বা লেনদেন হয়ে থাকে।
বিটকয়েন কি এটি নিয়ে বলতে গেলে আরো কিছু বিষয় আপনাদের জানা প্রয়োজন। সেগুলো হলো –
- বিটকয়েন অত্যন্ত মূল্যবান একটি কারেন্সি হলেও প্রতিটি বিটকয়েনের মূল্য কত টাকা সেটি সবসময় একই থাকেনা। বর্তমানে একটি বিটকয়েনের মূল্য পঞ্চাশ লাখ টাকার চাইতেও বেশি।
- বিটকয়েনের সবচাইতে ক্ষুদ্র অংশকে সাতোশি বলে৷ প্রতিটি বিটকয়েন ১০০ মিলিয়ন সাতোশির সমন্বয়ে গঠিত। এই ক্ষুদ্র অংশগুলো কেনার মাধ্যমে বিটকয়েনের মালিক হওয়ার সুযোগ রয়েছে৷
- বিটকয়েনের সংখ্যা অসংখ্য নয়। বর্তমানে বিদ্যমান বিটকয়েনের সংখ্যা ২১ মিলিয়ন৷
- বিটকয়েনের মাধ্যমে ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে কোন ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ডের প্রয়োজন নেই।
- বিটকয়েন কেনার ক্ষেত্রে কারো জন্য কোন বাড়তি শর্ত আরোপ করা হয়না।
- বিটকয়েন ব্যবহার করে হওয়া প্রতিটি ট্রানজেকশনের রেকর্ডআকারে সংরক্ষিত থাকে বিটকয়েনের ব্লকচেইনে। এর মাধ্যমে যারা লেনদেন করছেন, তাদের লেনদেন যে সম্পূর্ণ নিরাপদ সেটিই নিশ্চিত করা হয়।
এটুকুই ছিলো বিটকয়েন সম্পর্কে বেসিক ধারণা। আশা করি সবাই বিটকয়েন কি সেটি বুঝতে পেরেছেন।
বিটকয়েনের সুবিধা এবং অসুবিধা
বিটকয়েনের মূল সুবিধা হলো এটিতে লেনদেন করতে চাইলে অন্যান্য পেমেন্ট সিস্টেমের মতো বাড়তি চার্জ দিতে হয়না। উপরন্তু বিটকয়েনের মাধ্যমে আপনারা তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে লেনদেন করতে সক্ষম হবেন। এছাড়াও এই কারেন্সিতে লেনদেন করলে ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, তাই একজন লেনদেন করলে সেটি অন্য কারো পক্ষে নিয়ে নেয়া অসম্ভব।
এবার বিটকয়েনের অসুবিধা নিয়ে বলি৷ বিটকয়েনের একটি অসুবিধা হলো ব্যবহারকারীরা চাইলেই নিজেদের রিয়েল আইডেন্টিটি হাইড করে লেনদেন করতে পারেন। একারণে কেউ যদি বেআইনিভাবে লেনদেন করে থাকেন তাহলে তাকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে?
বিটকয়েন কি, বিটকয়েনের সুবিধা এবং অসুবিধা সেগুলো নিয়ে তো বলে ফেললাম, এবার চলুন এই বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে সেটি সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। আপনাদের তো আগেই বলেছি, এই কয়েনের মাধ্যমে লেনদেন করতে ব্যাংকের কোনোপ্রকার ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজন নেই। শুধু কার্ড ই বা বলছি কেন, বিটকয়েনের লেনদেন জনপ্রিয় পেমেন্ট রিলেটেড সার্ভিস প্রোভাইডার পেওনিয়ার কিংবা পেপালের ওপরেও নির্ভরশীল নয়৷ এর মূল কারণ হলো বিটকয়েন এমন এক ধরণের কারেন্সি যেটির মাধ্যমে ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে যে কারো পক্ষেই ট্রানজেকশন করা সম্ভব৷
বিটকয়েন যে ব্লকচেইন নামক নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সেই ব্লকচেইনের মাধ্যমেই এই কারেন্সিতে কে কখন কী পরিমাণ লেনদেন করছেন সেটির হিসাব রাখা হয়। বিটকয়েনে কে কতটুকু লেনদেন করছেন তা দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু একজনের লেনদেন কখনোই অন্য আরেকজন কন্ট্রোল করতে পারেননা৷
ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের অধীনে মাইনিং রিগ নামক এক ধরণের বিশেষ এবং শক্তিশালী কম্পিউটার ব্যবহার করে বিটকয়েন ব্যবহারকারীদের লেনদেন রেকর্ডেড থাকে৷ এই প্রসেসটিকে মাইনিং বলা হয় এবং যারা এই রেকর্ড রাখার কাজের সাথে সম্পৃক্ত তাদের মাইনার নামে চিহ্নিত করা হয়। সুতরাং মাইনার হলো তারাই যারা বিটকয়েন লেনদেন প্রক্রিয়া যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় সেটি মনিটর করে থাকেন। মাইনাররা তাদের কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে বিটকয়েন পেয়ে থাকেন।
কিভাবে বিটকয়েন থেকে আয় করা যায়?
বিটকয়েন থেকে আয়ের জনপ্রিয় কয়েকটি উপায় হলো –
- বিটকয়েন থেকে আয়ের একটি জনপ্রিয় উপায় হলো বিটকয়েন মাইনিং করা। মাইনিংয়ের মাধ্যমে বিটকয়েন লেনদেন করার ব্যবসা অনেকেই করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো এ কাজটি করার জন্য শক্তিশালী কম্পিউটার এবং উন্নতমানের গ্রাফিক্স কার্ড প্রয়োজন যা অনেকের কাছেই থাকেনা।
- বিটকয়েন থেকে আয়ের আরেকটি জনপ্রিয় উপায় হলো বিটকয়েন কিনে পরে সেটিকে চড়া দামে সেল করে দেয়া। যেহেতু বিটকয়েনের মূল্য কখনো বেশি থাকে আবার কখনো কম থাকে, একারণে অনেকেই কম মূল্যে বিটকয়েন কিনে পরবর্তীতে সেগুলোকে লাভে সেল করেন৷
- আজকালকার দিনে বহু মানুষ শেয়ারবাজারে টাকার বদলে বিটকয়েন বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এর কারণ হলো এই কয়েন বিনিয়োগে রিস্ক তুলনামূলকভাবে কম এবং এর চাহিদাও অনেক বেশি। তবে এক্ষেত্রে আমি বলবো, শেয়ারবাজারে বিটকয়েন বিনিয়োগ করতে চাইলে অবশ্যই আগে শেয়ারবাজার সম্পর্কে ভালোমতো জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন৷
- এছাড়াও বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট রয়েছে যে ওয়েবসাইটগুলোতে বিভিন্ন ছোট ছোট কাজের অফার থাকে, যেমনঃ বিভিন্ন গণিতবিষয়ক সমস্যার সমাধান করা। এ কাজগুলো করতে পারলে বিটকয়েন পেতে পারবেন এবং আয় করতে পারবেন। ওয়েবসাইটের পাশাপাশি এখন অনেক অ্যাপও রয়েছে যেগুলোতে বিটকয়েনের মাধ্যমে ইনকামের সুযোগ রয়েছে। অনেকেই নিজের হাতখরচ চালাতে এগুলোতে কাজ করেন৷ তবে সতর্কতা হিসেবে আমি বলবো, এই সাইট বা অ্যাপগুলোতে কাজ করার আগে জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন যে সাইটগুলো আসলেই বিটকয়েনে পেমেন্ট দেয় কিনা৷ কারণ পরিশ্রম বৃথা যাক তা আমরা কেউ ই চাইনা৷
আরো পড়ুনঃ আমাজন সম্পর্কে বিস্তারিতঃ এক বছরে আমাজন কত টাকা আয় করে জানতে চান?
বিটকয়েন থেকে বিকাশ ট্রান্সফার কি সম্ভব?
আমি জানি বিটকয়েন কি এবং এটি থেকে কিভাবে আয় করা সম্ভব এগুলো সম্পর্কে জানার পর অনেকেই জানতে চাইবেন বিটকয়েন থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা ট্রান্সফার সম্ভব কিনা। এই প্রশ্নটির উত্তর হলো আপনি বিটকয়েন থেকে সরাসরি নিজের বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করতে পারবেননা। কেননা, বাংলাদেশে বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেন এখনও লিগ্যাল হিসেবে স্বীকৃত নয়। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার বিটকয়েন প্রণয়ন করতে পারেনা এবং ব্যবহারকারীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে লেনদেন করে, সেহেতু এদেশে এই ডিজিটাল কয়েন ব্যবহার করা আইনস্বীকৃত নয়। তাই বিকাশ, নগদ, রকেট কিংবা ব্যাংক ট্রান্সফার কোনোটি দিয়েই সরাসরি আপনি বিটকয়েন থেকে টাকা ট্রান্সফারের কাজটি করতে পারবেননা।
তবে আশার কথা হলো, এখন অনেক থার্ড পার্টি ওয়েবসাইট রয়েছে যেগুলো বিটকয়েন থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকার এক্সচেঞ্জ করে থাকে। আপনি যদি বিটকয়েন থেকে টাকা বিকাশে নিতে চান, তাহলে এই ওয়েবসাইটগুলোতে অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে টাকা বিকাশে নিয়ে নিতে পারবেন। এখানেও অনুরোধ থাকবে, এসব ওয়েবসাইট নিয়ে আগে পর্যাপ্ত রিসার্চ করে তারপর বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ করবেন৷ নতুবা ভুয়া ওয়েবসাইটের পাল্লায় পড়ে আপনার বিটকয়েন খোয়া যেতে কিন্তু এক সেকেন্ডও লাগবেনা!
এটুকুই ছিলো বিটকয়েন কি এবং এটি সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা। সবার জন্য এটুকু বলতে চাই, যারা এই ধরণের ডিজিটাল কয়েনে লেনদেন করতে চান কিংবা এর সাহায্যে ইনকাম করতে চান, তারা অবশ্যই আগে এটি নিয়ে বিস্তারিতভাবে ধারণা নিয়ে নেবেন৷ এতে করে কোনোধরণের ভুল করার সম্ভাবনা থাকবেনা৷
Source : Investopedia