মার্ক জাকারর্বাগ – একজন স্বপ্নদ্রষ্টার জীবনের গল্প

আমাদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের অনেক বড় একটি অংশ দখল করে আছে নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তবে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যবহৃত যে সামাজিক মাধ্যমটি  এগিয়ে রয়েছে তার নাম হলো ফেসবুক। ইন্টারনেট দুনিয়ায় এমন কোনো মানুষ নেই যারা এই মাধ্যমটির নাম শোনেননি। দিনে অন্তত একবার হলেও ফেসবুকের নিউজফিড এবং নোটিফিকেশন চেক  না করে থাকার মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আর এই জনপ্রিয় নেটওয়ার্কিং সাইট এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন মার্ক জাকারর্বাগ।

বিশ্বের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং অফিস  কিংবা ছোট-বড় অরগানাইজেশন, তারা তাদের প্রচারণা  এবং বিজ্ঞাপনের জন্য ফেসবুকের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এ কারণেই গোটা বিশ্বে এক নামে জানে সবাই।  তার এই ফেসবুক উদ্ভাবনের কথা সবাই জানলেও কিভাবে শুরু হয়েছিল তারই অবিশ্বাস্য সফলতা দেখা পাওয়া, কেমন ছিল তার ব্যক্তিগত  ও শিক্ষাজীবন জীবন এবং তার অন্যান্য সামাজিক কাজে অবদান ও সফলতা  সম্পর্কে জানার আগ্রহ সবারই আছে। 

অনেকেই জানতে চান কিভাবে একজন মেধাবী ছাত্র মার্ক জাকারর্বাগ মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গা ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র একটি ওয়েবসাইটে পিছনে নিজের মেধা ও আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে আজ সফলতা চরম শিখরে পৌঁছেছেন।চলুন আজ আমরা জেনে নেই মার্ক জাকারবার্গ এর জীবনী সম্পর্কে।

কে এই মার্ক জাকারবার্গ?

মার্ক জাকারর্বাগ একজন আমেরিকান কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার ডেভেলপার যিনি বর্তমানে ফেসবুকের  প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যান। তিনি ২০১০ সালের টাইম ম্যাগাজিন অনুযায়ী  বিশ্বের ১০ জন প্রভাবশালী অর্থবিত্ত সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে “পারসন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।  

২০১৬ সালে  ফোর্বস  এ তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ৫ ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম স্থানে। ২০১৮ সালে তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৬৬.৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। বিশ্বের কনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে তার স্থান ২য়। এছাড়া ২০১০ সালে “The Accidental Billionaires”  বইয়ে উল্লেখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে মার্ক জুকারবাগ কে নিয়ে কি মুভি বের হয় যার নাম “দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক”।

বাল্যকাল ও শিক্ষা জীবন

মার্ক জাকারর্বাগ আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে ১৯৮৪ সালের ১৪ ই মে জন্মগ্রহণ করেন । তার বাবা এডওয়ার্ড জাকারবার্গ  পেশায় একজন ডেন্টিস্ট এবং মা কারেন পেশায় একজন সাইকোলজিস্ট। চার ভাই বোনের মাঝে তিনিই সবার বড়। তার তিন বোন হলেন রান্ডি, ডোনা এবং এরিয়েল

ছোটবেলা থেকেই প্রোগ্রামিং সম্পর্কিত বিষয়ে খুব আগ্রহ থাকায় মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যায়নের সময় মার্ক জাকারবার্গ শখের বসে সফটওয়্যার লেখা শুরু করেছিলেন। তার আগ্রহ দেখে তার বাবার ১৯৯০ সালে Atari Basic Programing  শেখান।১২ বছর বয়সে তিনি আটারি বেসিক প্রোগ্রামিং ব্যবহার করে একটি মেসেজিং প্রোগ্রাম তৈরি করেন যার নাম দেন জাকনেট। 

একই সময় তিনি synapse media player  নামের একটি মিউজিক প্লেয়ার তৈরি করেন যা একজন শ্রোতা গান শোনার পছন্দের তালিকা সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ পর্যন্ত Ardsley High school  এ অধ্যায়ন যাবৎকালে  তিনি গ্রীক ল্যাটিন ভাষায় জনপ্রিয় হয় উঠেন। এরপর 2000 সালে ফিলিপস এক্সেটার  একাডেমিতে  স্থানান্তরিত   হবার পর সেখানে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও ইংরেজি ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে পুরষ্কার পান। 

এছাড়া মার্ক জাকারর্বাগ অসিক্রীড়া তারকা ছিলেন এবং অসিক্রীড়া দলের অধিনায়ক ছিলেন।পাশাপাশি কলেজে তিনি মহাকাব্যিক কবিতার লাইন থেকে আবৃত্তি করার জন্যও পরিচিত ছিলেন।

যে ভাবে শুরু হয়েছিলো 

২০০২ সালে ফিলিপস এক্সেটার একাডেমী থেকে পাস করে মার্ক জাকারর্বাগ  যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি তখন, সেখানে তিনি CourseMatch নামে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেন যেটি শিক্ষার্থীদের তাদের কোর্স সিলেক্ট করতে এবং স্টাডি গ্রুপ বেছে নিতে সাহায্য করত।

২০০৩ সালের দ্বিতীয় বর্ষ চলাকালীন সময় তিনি ফেসবুকের পূর্বসূরী সাইট ফ্রেশমেশ আবিষ্কার করেন। এখানে তিনি হার্ভার্ডের নয়টি হাউজের শিক্ষার্থীদের ছবি ব্যবহার করে কোন ছবিটি ভালো সেটির একটি ভোটিং সিস্টেম করেন। তার এই ধরনের পরিকল্পনায় চার ঘণ্টায়  ৪৫০ ভিজিটর ছবিতে অনলাইনের মাধ্যমে ভোট দেয়। তার এ ধরনের আবিষ্কার শিক্ষার্থীদের মধ্যে তখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

শেষমেষ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই 2004 সালের ফেব্রুয়ারিতে হাভার্ডের ডরমেটরিতে  Thefacebook.com নামের সাইটের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর যখন সাইটটিতে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই সাইটটি বেশি সময় নিয়ে কাজ করার জন্য।  ফলে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউট করেন। 

এরপর মার্ক জাকারর্বাগ তার বন্ধু Cris Hughes, Eduardo Saverin, Andrew McCollum এবং Dustin Moskovitz কে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আলটোতে নতুন অফিসে কাজ করা শুরু করেন।

২০০৫ সালের আগস্টে Thefacebook.com নাম পরিবর্তন করে কোম্পানির নাম রাখা হয় শুধু ফেসবুক। এই সময় মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক প্ল্যাটফর্মের সাথে Beacon এবং Connect নামে দুইটি সার্ভিস যোগ করেন । ফেসবুক শুরুতে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের জন্য হলে ২০০৫ সাল থেকে ফেসবুক সারাবিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৯ মিলিয়নে দাঁড়ায়।

ফেসবুকের জনপ্রিয়তা দেখে বিভিন্ন কোম্পানি যেমন ইয়াহু, MTV Networks থেকে সাইটটি কিনে নিতে চাইলে ফেসবুকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদেরকে না করে দেন। বরং তিনি সাইটটি আরো ফেসবুকে নতুন নতুন ফিচারস যোগ করতে মনোযোগ দেন।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইন্টারনেটের ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষে ২০১৩ সালে মার্ক বিভিন্ন সেল ফোন ফার্মস যেমন Quacomm, Samsung, Opera Software, Ericsson, Microsoft, MediaTek এবংReliance এর সাথে internet.org নামে একটি নতুন প্রজেক্ট শুরু করেন। এরপর মার্ক ফেসবুকের সাথে ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ সহ আরো কিছু অ্যাপস যুক্ত করেন যা ফেসবুকের জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে তোলে।

২০১২ সালে ফেসবুক প্রথমবারের মতো যখন শেয়ারবাজারে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সমাগম ঘটে তখন তারা প্রচুর পরিমাণে আইপিও অর্জন করে। এর পূর্বে কোন ইন্টারনেটভিত্তিক কোম্পানি এত বড় আইপিও অর্জন করতে পারেনি। কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়ার পর প্রাথমিক সাফল্যের পর ফেসবুকে শেয়ার দাম বেশ পড়ে গেলেও  বাজারে তার প্রতিষ্ঠান উত্থান ও পতনের সময়  যে সাহসিকতার সাথে তা মোকাবেলা করেছেন তা দেখার জন্য অনেকেই মুখিয়ে ছিলেন।

Read More

চ্যাট জিপিটির ব্যবহার : 2023 সালে চ্যাট জিপিটি কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় হয়ে উঠুন Most Successful

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন

২০১২ সালের ১৯শে মে মার্ক জাকারর্বাগ তার সহপাঠী Priscilla chan এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবব্ধ হন। তার পরিবারে স্ত্রী সহ রয়েছে দুই মেয়ে।তাদের দুই মেয়ের নাম হল ম্যাক্স চান জাকারবার্গ এবং অগাস্ট চান জাকারবার্গ।

তার বড় সন্তান ম্যাক্স এর জন্মের পর তিনি তাঁর পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য দুই মাসের পিতৃত্বকালীন ছুটি তে যান। এসময় তিনি স্ত্রী ও কন্যা কে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি প্রকাশ করেন এই মর্মে যে তারা তাদের অধিকারে থাকা ফেসবুকে শেয়ারের ৯৯% দাতব্যকাজে দান করে যাবেন। 

চিঠিতে তাঁরা লেখেন “আমরা আমাদের ক্ষূদ্র সামর্থ দিয়ে পৃথিবীকে সব শিশুর জন্য আরেকটু সুন্দর স্থান বানানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা আমাদের ফেসবুক শেয়ারের ৯৯ শতাংশ – যা বর্তমানে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার – অন্য অনেকে যারা পরবর্তী প্রজন্মের কল্যানে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করার প্রয়াসে নেমেছেন তাঁদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দান করে যাবো।

সবাই বলে থাকেন বাল্যকাল থেকেই ব্যক্তি হিসেবে মার্ক জাকারর্বাগ বেশ মিশুক দৃঢ় মানসিকতার অধিকারী এবং পরিশ্রমী ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল  দেশের মানুষকে পরস্পরের কাছে নিয়ে আসা। ফেসবুক কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি পাবার পর এক বার্তায় তিনি বলেন” ফেসবুক কেবল একটি কোম্পানি হিসেবে তৈরী করা হয়নি। একটি সামাজিক লক্ষ্যকে কাজে প্রতিফলিত করার জন্যই এটি তৈরি করা হয়েছে আর এই লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবী বিশ্বকে আরো অবাধ্য উন্মুক্ত করা এবং যোগাযোগ বৃদ্ধি করা।

এই দম্পতি “চ্যান-জুকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ” (সি জেড আই) নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং        ঘোষণা দেন যে  – যেই সংস্থায় তাঁরা তাঁদের ফেসবুক শেয়ার দান করেছেন, তারা আমাদের সন্তানদের জীবনকালে সকল রোগের প্রতিকার আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অন্তত তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল বরাদ্দ করবে।।

এছাড়াও তারা চ্যান-জুকারবার্গ বায়োহাব প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এই বায়োহাবটি সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক একটি স্বায়ত্বশাসিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র যেখানে প্রকৌশলী, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, প্রাণরসায়নবিদ – ইত্যাদি সব ধরনের বৈজ্ঞানিকদের একটি মিলনমেলা ঘটবে এবং তাঁরা একসাথে কাজ করবেন।

এই গবেষণা কেন্দ্রটির জন্য বিশ্বের সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন  স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সানফ্রান্সিস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বারকেলি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে একসাথে কাজ করার চুক্তিতে আবদ্ধ দশ বছর সময়কালীন ৬০০ মিলিয়ন ডলারের প্রাইমারি ফান্ড বরাদ্দ করে দেয়া হয়। 

ব্যাক্তি হিসেবে মার্ক জাকারর্বাগ  এর কিছু কথা এবং বৈশিষ্ট্য সবার মাঝে আলাদা করে তুলে ধরে। তিনি মনে করেন যেকোনো কাজ নিখুঁত কাজ প্রয়োজনীয় কিন্তু নিখুঁত কাজের চেয়ে কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারটাই মুখ্য। অনেক ব্যক্তিরা তার কাছে প্রশ্ন করে ঝুঁকি নেওয়া ব্যাপারে তার ধ্যান ধারণা সম্পর্কে। 

তিনি মনে করেন ঝুঁকি নেওয়াটা  কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ নয়, কেননা একটিমাত্র পদ্ধতি অবলম্বন করে বিশ্বকে অবশ্যই  পরিবর্তন করা সম্ভব আর তাহলো ঝুঁকি নেওয়া। এছাড়া তিনি আরও বলেন  মানুষ তার নিজের পছন্দমতো যেকোনো কাজ করা উচিত। 

আপনি যদি আপনার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করেন এবং আপনার কাজকে ভালোবেসে ফেলেন তাহলে  সেই কাজটি করতে আপনার শুধু ভালোবাসাই যথেষ্ট  কোনো মাস্টার প্ল্যান নয়।মার্ক জাকারবার্গ সবসময় লক্ষ্য অর্জনের দিকে ফোকাস করতে বলেন। কারণ তিনি মনে করেন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই মূল বিষয় হওয়া উচিৎ।

মার্ক জাকারর্বাগ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথেও জড়িত। তিনি নিয়মিত Newark Public Schools এবং San Francisco General Hospital এ ডোনেশন দেন এবং পশ্চিম আফ্রিকা তে ইবোলা রোগে আক্রান্তদের জন্য তিনি ২৫ মিলিয়ন ডলার দান করেন।তার সামাজিক দাতব্য কর্মকান্ড নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা অর্থ আয়ের জন্য সেবা প্রদান করি না, আমরা আয় করি আরো ভালো সেবা প্রদানের জন্য”।

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজ থেকে!

Leave a Comment