ল্যারি পেজ – হার না মানা এক যোদ্ধা

আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির দুনিয়ায় খুব কম মানুষই আছেন গুগল সম্পর্কে জানেন না কিংবা নিজের প্রাত্যহিক কাজে গুগল ব্যবহার করেননা। এবার বলুন তো, ল্যারি পেজ – নামটা কি একটু পরিচিত লাগছে? 

কে এই ল্যারি পেজ? 

আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের কথা বলছি তাহলে আপনার ভাবনাটি একদম সঠিক। ল্যারি পেজ  একজন আমেরিকান অনট্রোপ্রনোর বা উদ্যোক্তা এবং একইসাথে একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তবে তিনি বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বেশি পরিচিত। এর পাশাপাশি বর্তমানে তিনি তার ১২১ বিলিয়ন ডলার সম্পদের কারণে  পৃথিবীর শীর্ষ স্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। 

ছোটবেলা থেকেই ল্যারি স্বপ্ন দেখতেন বড় কিছু করার। নতুন কিছু আবিষ্কারের তুমুল ইচ্ছা ছিলো এই মানুষটির। এমন দূরদর্শিতা এবং  আত্মবিশ্বাসী মনোভাবই তাকে পরবর্তীতে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠেতে সবথেকে বেশি সাহায্য করেছিল। আর এ কারণেই আজ, গুগলকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কোম্পানি  হিসাবে উল্লেখ করা হয়। 

যদিও পৃথিবীর সব থেকে সফল কোম্পানির  প্রতিষ্ঠাতা হয়েও ল্যারি পেজের জীবন খুব একটা সুখকর ছিল না। যখন তিনি সফলতার একদম শীর্ষে , তখনই তাকে মুখোমুখি হতে  হয় এক বিশাল বড় ধাক্কার। অন্য কেউ এমন পরিস্থিতির স্বীকার হলে হয়তো থেমে যেতো। অসামান্য এই মেধাবী মানুষটির যাত্রাও এখানেই থেমে যাবার কথা থাকলেও তিনি কিন্তু থেমে যাননি। বরং চলার পথে বিরাজ করা সকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে ল্যারি পেজের একের পর এক অবদান ও সৃষ্টিই তাকে একাধারে দুনিয়ার  ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সারিতে জায়গা করে দিয়েছে। আর এই কারণেই তিনি বর্তমান তরুণ সমাজের কাছে এক অনুকরণীয় আদর্শ। আজকের এই  আর্টিকেলটি ল্যারি পেজের সাফল্যের গল্পকে নিয়ে । তাহলে চলুন আর দেরি না করে জেনে নেই তার সাফল্যের আদ্যোপান্ত। 

ল্যারি পেজের বাল্যকাল, শিক্ষাজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবন 

মিশিগানের ইস্ট ল্যান্সিংয়ে ১৯৭৩ সালে জন্মগ্রহন করেন ল্যারি পেজ । তার বাবা, কার্ল পেজ পেশায় ছিলেন একজন  কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তাকে একইসাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একজন অগ্রগামী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয় । তার মা গ্লোরিয়া লাইম্যান ব্রিগস কলেজের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বিষয়ের প্রভাষক ছিলেন।  তিনি মূলত শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখাতেন। মূলত এসব কারণে শৈশবে ল্যারি পেজের বাড়ি কম্পিউটার এবং বিজ্ঞানের নানা পত্র-পত্রিকায় পূর্ণ ছিল । ফলে অল্প বয়সেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি ল্যারি পেজের আকর্ষণ বাড়তে থাকে। পাশাপাশি তিনি ব্যবসা এবং নানা উদ্ভাব্নী কাজেও আগ্রহী হতে শুরু করেন ।

ল্যারি পেজ ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মিশিগানের ওকেমোসের ওকেমোস মন্টেসরি স্কুলে (এখন মন্টেসরি র‌্যাডমুর নামে পরিচিত) পড়াশোনা করেন এবং ১৯৯১ সালে ইস্ট ল্যান্সিং হাই স্কুল থেকে  ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ল্যারি মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে, পেজ লেগো ব্রিক দিয়ে তৈরি একটি ইঙ্কজেট প্রিন্টার তৈরি করেন যার আক্ষরিক অর্থ ছিলো একটি লাইন প্লটার।  তিনি ভেবেছিলেন ইঙ্কজেট কার্টিজ ব্যবহার করে অল্প খরচে বড় সাইজের পোস্টারগুলো সহজেই  মুদ্রণ করা সম্ভব হবে। তিনি খুব অল্প সময়ে সেই প্রিন্টার থেকে  ইতিবাচক ফলাফল পান যা আশেপাশের সবাইকে রীতিমতো অবাক করে দিয়েছিলো।

এবার আসি ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। ল্যারিপেজের ব্যক্তিগত জীবন বাকি আট-দশজন সফল ব্যাক্তিদের থেকে অনেক আলাদা বলা চলে । অনেক গণমাধ্যম দাবি করে তিনি তার ব্যাক্তিগত জীবন খুব একটা পর্দার সামনে নিয়ে আসতে পছন্দ করেন না। ল্যারি পেজ ২০০৭ সালে লুসিন্ডা সাউথওয়ার্থকে বিয়ে করেন।সাউথওয়ার্থ একজন পেশায় একজন গবেষক। ল্যারি পেজ এবং সাউথওয়ার্থের ঘরে দুটি সন্তান আছে। 

ল্যারি পেজের সাফল্যের পথ চলা এবং মানব কল্যাণে অবদান

ল্যারি পেইজ তথ্যপ্রযুক্তিতে  একদিন অনেক বড় একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন এটি ছোটবেলা থেকেই সবাই বুঝতে পেরেছিল যখন তিনি ছাত্র অবস্থায় কম্পিউটার ব্যবহার করে একটি বিজ্ঞান অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করেছিলেন। 

তরুণ ল্যারি পেজের জীবনে সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে এসেছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিবাসী বিজ্ঞানের ছাত্র সের্গেই ব্রিন। তাদের সম্পর্কের শুরুটা তিক্ততা ও ঘৃনা দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। দুই বন্ধু স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় ব্যাকরাব নামের একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান ইঞ্জিন তৈরি করেন। এই সার্চ ইঞ্জিনে শিক্ষার্থীরা তথ্য অনুসন্ধান করার মাধ্যমে নানাভাবে সুবিধা পেতে শুরু করে।  এই সার্চ ইঞ্জিনের আবিস্কার আশেপাশের এলাকাকে ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে এক বিশাল আলোড়ন তৈরি করেছিলো। 

এই ছোট পরিসরের সৃষ্টি থেকেই তাদের মাথায় আরো বড় একটি আইডিয়া আসে। গোটা বিশ্বের মানুষ কিভাবে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একটি বিশাল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে তথ্য খুঁজে পেতে পারে সেটি নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা শুরু করেন ।

তবে এখানে একটি মজার গল্প রয়েছে যেটি না ললেই নয়। তাদের আবিস্কার করা সার্চ ইঞ্জিনটি ক্রয় করে নেওয়ার জন্য তখন বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান রীতিমতো প্রস্তুত ছিলো । এমনকি তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থও অফার করেছিলো সেসব কোম্পানিগুলো। 

তবে ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন নিজেদের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তাদের আবিষ্কারকে বিক্রি না করে বিশ্বের বড় বড় বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলো। ফলে তাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আর কখনো। তাদের সার্চ ইঞ্জিন খুব অল্প সময়ে ইন্টারনেটে র‍্যাংক করে ভালোভাবে জায়গা দখল করে নেয়। 

ল্যারি পেজ

এরপর ১৯৯৭ সালে ল্যারি পেজ এবং ব্রিন BackRub  এর নাম পরিবর্তন করে গুগল নামকরণ করেন । তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো ওয়েব বা ইন্টারনেটে অ্যাভেইলেবল থাকা বিশ্বের সমস্ত তথ্য সংগঠিত করা । এরই ধারাবাহিকতায় তারা ১৯৯৮ সালে Google Inc. কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর কোম্পানির অগ্রগতির সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের সাথে ল্যারির সম্পৃক্ততা বেড়ে যায়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ল্যারি পেজ সিইও পদ লাভ করেন।

তারপর থেকে সময়ের সাথে সাথে তিনি একজন সফল  সিইও হয়ে উঠেছেন। এখন তিনি অ্যান্ড্রয়েড এবং গুগল প্লাসের মতো প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।  তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন প্লেন যে তিনি ছোট থেকেই যেকোনো বিষয় নিয়ে অনেক কৌতুহলী ছিলেন। তিনি ছোটবেলা হতেই তার লক্ষ্য স্থির করেছিলেন যে তিনি বড় হয়ে একজন উদ্যোক্তা হবেন এবং মানব কল্যাণে নানারকম প্রযুক্তির আবিষ্কার করবেন। 

তার ছোটবেলার এই স্বপ্নটিই  তৈরি করেছে গুগলের মত বিশাল এক সফল কোম্পানিকে যা বর্তমানে পৃথিবীর মানব কল্যাণে বর্তমানে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন মানুষ গুগলে সার্চ করার মাধ্যমে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিনে পরিণত হয়েছে। 

কী ছিলো ল্যারি পেজের জীবনের বাধা?

ল্যারি পেজের জীবনটা কিন্তু সবসময় সহজ ছিলোনা। সাফল্যের শীর্ষে থাকা তার জীবনে  অপেক্ষা করছিলো এক বড় ধাক্কা তা হয়তো কেউই ভাবেনি। ল্যারি পেজের ভোকাল কর্ড হাশিমোটোর থাইরয়েডাইটিসের ফলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয় । এটি প্রথম ধরা পড়ে ১৯৯৯ সালে এবং তখন শুধুমাত্র বাম ভোকাল কর্ড অবশ হয়ে যায়।  পরবর্তীতে ২০১৩ সালে  ল্যারি পেজের ডান ভোকাল ফোর্ড পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। 

তবে এমন ধাক্কায় তিনি দমে না গিয়ে  বোস্টনের ভয়েস হেলথ ইন্সটিটিউটকে অর্থ প্রদান শুরু করেন, যারা  ভোকাল কর্ড এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা আরো ভালভাবে গবেষণার জন্য কাজ করেন।এত বিশাল বিশাল বাধা সত্ত্বেও ল্যারি পেজকে কখনো কোনো বাধা আটকে রাখতে পারেনি। তার নেতৃত্বাধীন  গুগলের নানা আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Orkut,Google Maps, Blogger Mobile, Google Reader,  iGoogle  YouTube ইত্যাদি যেগুলো আন্তজার্তিক বাজারে প্রায় ১৮০ বিলিয়ন মূলধন তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি গুগলের নানা অ্যাপের মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষাগ্রহণ  সহজলভ্য হয়েছে। 

এছাড়া ল্যারি পেজ Google.org নামের একটি ওয়েব সাইট  তৈরি করেন যা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার মতো সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে সাহায্য প্রদান করে । এরপর ২০০৬ সালে, ল্যারি পেজ কার্ল ভিক্টর পেজ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু করেন। এই ফাউন্ডেশন থেকে ২০১৩ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার  দান করা হয়েছিলো বলে জানা যায়।

Read More

অল্প পুঁজিতে বিজনেস করে লাখপতি হতে চাইছেন?জেনে নিন 12 টি Best Profitable ছোট বিজনেস আইডিয়া সম্পর্কে

ল্যারি পেজের জীবনের খ্যাতি 

ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্স ল্যারি পেজকে বিশ্বের ১৭ তম ধনী ব্যক্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত করে এবং ফরচুন ম্যাগাজিন পেজকে তার “Businessperson of the Year” হিসেবে ঘোষণা করে এবং একইসাথে তাকে “বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী সিইও” ঘোষণা করে।শুধু তাই নয় ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী তিনি ২০১৫ সালে তার কর্মচারীদের ভোটে America’s Most Popular Chief Executive” নির্বাচিত হন। এভাবেই ল্যারি পেইজ সব বাধাকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর সফল ব্যক্তিদের তালিকায় নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে ফেলেন।

ল্যারি পেজের গল্প আমাদের কী শেখায়?

ল্যারি পেজের সাফল্যের গল্প থেকে আমাদের কাছে ৩টি  বিষয় অনুকরণীয় হতে পারে। যেমনঃ

  • আমরা জীবনে যা করতে চাই বা হতে চাই তার  একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আগেই স্থির করা যাতে পরবর্তীতে ওই লক্ষ্য বুঝে কাজ করতে পারি ।
  • ক্ষণস্থায়ী লাভের আশায় অর্থমূল্যের কাছে পরাজিত না হয়ে কোনো একটা বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা।
  • জীবনে যত বাধাই আসুক না কেন, কখনো হার না মানা। 

 

পরিশেষে বলা যায়, ল্যারি পেজের অসামান্য অবদান তাকে  ইন্টারনেটের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার বাল্যকাল ,শিক্ষাজীবন , ব্যক্তিগত জীবন এবং কর্মজীবনের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে অনুপ্রেরণামূলক শিক্ষা। আপনিও যদি ল্যারি পেজের  মত একজন সফল ব্যক্তি হতে চান,  তাহলে এখন থেকেই লক্ষ্য স্থির করে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হার না মানা এক যোদ্ধা হয়ে উঠুন।

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজ থেকে!

Leave a Comment