আমাজন – বিশ্বখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটির নাম নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। যদি আমি বিশ্বের দশটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান নিয়ে কথা বলতে চাই তাহলে কিন্তু আমাজনের নাম থাকবে একদম শুরুর দিকেই। শুধুমাত্র খ্যাতির দিক থেকেই নয়, আমাজন তার আয়ের অংকের মাধ্যমে অবাক করে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। অনেকেই জানতে চান আমাজন কী, আমাজনের ইতিহাস কিংবা আমাজন এক বছরে কত টাকা আয় করে। কি ভাবছেন? কোথা থেকে এগুলো জানতে পারবেন? আর চিন্তা নেই, কারণ আজ আমি আপনাদের সবাইকে জানাবো আমাজন কী, আমাজনের ইতিহাস, এটির আয়ের উৎস এবং এক বছরে আমাজন কত টাকা আয় করে সে বিষয়গুলো সম্পর্কে, যেগুলো জানার মাধ্যমে আপনারা এই প্রতিষ্ঠানের পরিধি সম্পর্কে খুব সহজেই ধারণা পেয়ে যাবেন৷
আমাজন কী?
যেকোনো বিষয় সম্পর্কে কোনো বিশেষ তথ্য জানার আগে সে বিষয়টি সম্পর্কে একটু রিসার্চ করে নেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। তাই আমাজন কত টাকা আয় করে সেটি জানার আগে চলুন আমাজন কী সে সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
সহজ বাংলায় আমাজন হলো একটি ইলেকট্রনিক কমার্স বেইজড প্রতিষ্ঠান। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন রিটেইলিং কোম্পানি যা ই-কমার্স, ক্লাউড সার্ভিস এবং ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজিং সার্ভিস প্রদান করে থাকে। ১৯৯৪ সালে জেফ বেজোসের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে আমেরিকান এই প্রতিষ্ঠানটি। আমাজনের হেডকোয়ার্টার ওয়াশিংটনের সিয়াটলে অবস্থিত।
আমাজন যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনলাইন রিটেল সার্ভিস এবং বিভিন্ন ওয়েব সার্ভিস দিয়ে থাকে৷ আমাজনের রয়েছে আমাজন প্রাইম নামক নিজস্ব ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম। শুধু তাই নয়, আমাজন ভার্চুয়াল পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট আলেক্সা এবং বিখ্যাত ই-বুক রিডার কিন্ডলের ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবেও সবার কাছে পরিচিত। তাই বলা যেতে পারে, আমাজন এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেটির আয়ের উৎস একটি নয়, বরং প্রতিবছর কয়েকটি উৎস থেকে আমাজন আয় করে থাকে৷
আমাজন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
আমাজন ডট কম কিন্তু শুরুতে এত বিখ্যাত একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ছিলোনা। যখন এই প্রতিষ্ঠানটির পথচলা শুরু হয়েছিলো, তখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সংখ্যাও ছিলো অনেক কম।
তাহলে কেন এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিলো? আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস তার নিজের রিসার্চ স্কিল এবং বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন একসময় বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। তাই যদি তিনি অনলাইনে কেনাকাটা করার মতো একটি নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেন, তাহলে সেটি হবে একটি চমৎকার উদ্যোগ।
জেফ বেজোস তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসের ৫ তারিখে নিজের বাড়ির গ্যারেজে মাত্র তিনটি কম্পিউটার এবং তিনজন সহযোগীকে সাথে নিয়ে অনলাইন লাইব্রেরি অর্থাৎ অনলাইনে বই বিক্রি করার ওয়েবসাইট হিসেবে আমাজনের যাত্রা শুরু করেন। তিনি সাইটের নাম আমাজন রেখেছিলেন বিখ্যাত নদী আমাজনের সাথে মিল রেখে। তিনি চেয়েছিলেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান আমাজন ডট কমকেও সবাই আমাজন নদীর মতো একনামে চিনুক।
এভাবেই বহু অনিশ্চয়তা এবং একরাশ স্বপ্ন নিয়ে আমাজনের পথচলা শুরু হয়েছিলো। সেসময় অনলাইনে কেনাকাটার এত চল না থাকলেও আমাজন খুব দ্রুতই সকলের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। আর আজ আমাজন পৃথিবীর সবচাইতে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি।
আমাজন কোন কোন উৎস থেকে আয় করে?
এবার একটু আমাজনের আয়ের মূল উৎসগুলো নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে বলি৷ আমাজনের পুরো বিজনেস সেকশনকে মূলত তিনটি আলাদা সেক্টরে ভাগ করা যায়, যেগুলো হলো নর্থ আমেরিকা, ইন্টারন্যাশনাল এবং আমাজন ওয়েব সার্ভিস বা AWS। এর মধ্যে নর্থ আমেরিকা এবং ইন্টারন্যাশনাল – এই দুটি সেগমেন্ট দিয়ে আমাজনের পুরো রিটেইল সার্ভিস কোন কোন জিওগ্রাফিক এরিয়াজুড়ে বিস্তৃত সেটি বোঝানো হয়৷
আপনারা জেনে অবাক হবেন আমাজনের অনেকগুলো আয়ের উৎস থাকলেও এর রেভিনিউয়ের সিংহভাগই আসে রিটেইল সার্ভিসের সেল থেকে৷ তাই এবার জানাবো রিটেইল সার্ভিস নিয়ে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ।
আপনারা নিশ্চয়ই বাইরের দেশের মানুষদের মুখে শুনেছেন যে তারা আমাজন ডট কম থেকে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে থাকে। বাংলাদেশে আমাজন থেকে কেনাকাটা করার সুবিধা না থাকলেও অন্যান্য দেশে অনেক আগে থেকেই এই সুবিধাটি রয়েছে৷ আমাজন ডট কমে কসমেটিকস, ইলেকট্রনিকস, বাচ্চাদের খেলনাসহ গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। আমাজন ডট কমের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো ক্রেতাদেরকে সর্বোচ্চ মানের অনলাইন শপিং এক্সপেরিয়েন্স দেয়া। একারণে যাত্রা শুরু করার পর থেকেই সহজে পেমেন্ট করার সুবিধা, দ্রুত ডেলিভারি, বিভিন্ন অফার এবং টপ নচ কাস্টমার সার্ভিসের মাধ্যমে এটি জয় করে নিয়েছে কাস্টমারদের মন৷
আমাজনের রিটেইল সার্ভিস থেকে রেভিনিউ জেনারেট হয় অনলাইন স্টোর এবং ফিজিকাল স্টোর দুটি থেকেই৷ তবে তুলনা করলে দেখা যায়, প্রতিবছর অনলাইন স্টোর থেকেই অধিক পরিমাণ রেভিনিউ জেনারেট হয়ে থাকে৷ সত্যি বলতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা করা সত্ত্বেও আমাজনের বিজনেসের ইন্টারন্যাশনাল সেক্টরটি সেভাবে নর্থ আমেরিকার মতো শক্তপোক্ত নয়৷ অন্যান্য দেশগুলোতে আমাজনের অনলাইন স্টোর থেকে বিভিন্ন প্রোডাক্টের পাশাপাশি অনলাইন সাবস্ক্রিপশনও সেল করা হয়৷ এ দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ইন্ডিয়া, চায়না, জার্মানী, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ইতালি, জাপান ইত্যাদি।
যদি রিটেইল সেক্টরের টোটাল রেভিনিউ নিয়ে বলতে হয়, তাহলে বলা যায় এই রেভিনিউয়ের বড় একটি অংশই আসে নর্থ আমেরিকা এরিয়া থেকে৷ যেমনঃ ২০১৮ সালে শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকা থেকে আমাজনের আয় ছিলো ১৪১.৪ বিলিয়ন ডলার এবং অপারেটিং আয় ছিলো ৭.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ছিলো প্রতিষ্ঠানের মোট আয়ের প্রায় ৬০ পারসেন্ট। তাই এই উত্তর আমেরিকা এরিয়াকে আমাজনের মেইন বিজনেস জোন বললে মোটেও ভুল বলা হবেনা।
এবার আসি AWS বা আমাজন ওয়েব সার্ভিস নিয়ে। আমাজন ওয়েব সার্ভিস চালু করা হয় ২০১৬ সাল থেকে। এটিকে আমাজনের ক্লাউড সার্ভিসও বলা যায়। ক্লাউড সার্ভিস এমন একটি সার্ভিস যার মাধ্যমে যেকোনো প্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজনীর তথ্য বা ডাটা সেভ করার কাজে এই সার্ভিস ব্যবহার করতে পারে৷ আপনারা গুগল ক্লাউডের নাম শুনেছেননা? আমাজন ওয়েব সার্ভিস কিন্তু মার্কেটে গুগল ক্লাউডের প্রতিদ্বন্দ্বী! আমাজন ওয়েব সার্ভিস শুরু হওয়ার পর থেকেই এখান থেকে জেনারেট করা রেভিনিউয়ের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৮ সালে এর রেভিনিউয়ের পরিমাণ ছিলো ২৫.৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ২১৭৮৮৪.৬ টাকা।
ওয়েব সার্ভিসের পাশাপাশি আমাজন পা রেখেছে অ্যাডভারটাইজিংয়ের জগতে এবং বিচরণ করে যাচ্ছে সাফল্যের সাথে। আশা করা যায়, যত সময় যাবে, এখান থেকে আরো বেশি পরিমাণ রেভিনিউ জেনারেট করা সম্ভব হবে।
আরো পড়ুনঃ জানেন কী এক বছরে ফেসবুক কত টাকা আয় করে?
এক বছরে আমাজন কত টাকা আয় করে?
এখন আমরা চলে এসেছি আজকের লেখার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশে। এখন আমি আপনাদের জানাবো এক বছরে আমাজন কত টাকা আয় করে। আপনাদের বোঝার সুবিধার জন্য আমি এখানে বিগত পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমাজন কত টাকা আয় করে সেটি ইউএস ডলারে কত এবং বাংলাদেশি টাকায় কত দুটি হিসাবই দেখিয়েছি। যাতে করে বিগত কয়েক বছরে আমাজনের গ্রোথ সম্পর্কে আপনারা আইডিয়া করতে পারেন।
সালঃ ২০২১
নর্থ আমেরিকা – ২৮০ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [২৩৭৩৮৪০ কোটি টাকা]
ইন্টারন্যাশনাল – ১২৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়),
[১০৮৫১৮৪ কোটি টাকা ]
Aws – ৬২ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [৫২৫৬৩৬ কোটি টাকা ]
সালঃ ২০২০
নর্থ আমেরিকা – ২৩৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [২০০০৮০৮ কোটি টাকা]
ইন্টারন্যাশনাল – ১০৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [৮৮১৭১২ কোটি টাকা]
Aws – ৪৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [৩৮১৫১০ কোটি টাকা ]
সালঃ ২০১৯
নর্থ আমেরিকা – ১৭১বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [১৪৪৯৭৩৮ কোটি টাকা]
ইন্টারন্যাশনাল – ৭৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [৬৩৫৮৫০ কোটি টাকা]
Aws -৩৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [ ২৯৬৭৩০ কোটি টাকা ]
সালঃ ২০১৮
নর্থ আমেরিকা – ১৪১ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়),[ ১১৯৫৩৯৮ কোটি টাকা]
ইন্টারন্যাশনাল – ৬৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [৫৫৯৫৪৮ কোটি টাকা]
Aws -২৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [২১১৯৫০ কোটি টাকা]
সালঃ ২০১৭
নর্থ আমেরিকা – ১০৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [৮৯৮৬৬৮ কোটি টাকা]
ইন্টারন্যাশনাল – ৫৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [৪৫৭৮১২ কোটি টাকা]
Aws -১৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায়), [১১৪১২৬ কোটি টাকা]
এটুকুই ছিলো আমাজন কি এবং এক বছরে আমাজন কত টাকা আয় করে সেই সম্পর্কিত আলোচনা। আপনারা নিশ্চয়ই আজকের লেখা থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছেন যে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ চাইলেই নিজের মনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। তাই নিজের স্বপ্ন পূরণে কখনোই পিছপা হবেননা। সবসময় দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যান, দেখবেন সাফল্য আপনার হাতে এসে ধরা দেবে৷
Source:
https://www.statista.com/statistics/266289/net-revenue-of-amazon-by-region/