স্টিভ জবস- এক লড়াকু Successful ব্যক্তির গল্প

বিশ্ব বিখ্যাত ব্র্যান্ড অ্যাপলের নাম শোনেননি এমন মানুষ এখন একজনও নেই। আপনারা অনেকে নিশ্চয়ই নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে অ্যাপলের বিভিন্ন গ্যাজেট, যেমন আইফোন, আইপ্যাড কিংবা ম্যাকবুক ইউজ করেন। ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের জগতে আলোড়ন ঘটিয়ে তুলতে যে মানুষটি প্রত্যক্ষভাবে অবদান রেখেছেন তিনি হলেন অ্যাপলের কো ফাউন্ডার স্টিভ জবস। 

শুধুমাত্র অ্যাপলই বা বলছি কেন, স্টিভ জবসকে পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও সবাই এক নামে চেনে। ইলেকট্রনিক্সের জগতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়া এই মানুষটির জীবনের গল্পও কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। স্টিভ জবস তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হওয়ার পরেও জীবনে দেখা পেয়েছেন চরম সাফল্যের। আজকের লেখায় আমরা জানব স্টিভ জবসের জীবনের সেই অনুপ্রেরণামূলক গল্পটি সম্পর্কে বিস্তারিত। 

কেমন ছিলো স্টিভ জবসের ছোটবেলা? 

চলুন লেখার শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক স্টিভ জবসের ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু তথ্য। স্টিভ জবসের পুরো নাম স্টিভেন পল জবস। তিনি ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জন জানডালি ও মাতা জোয়ান শিবেল দুজনেই ছিলেন উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। স্টিভ জবসের জীবনের প্রথম দুর্ভাগ্যটি তার একদম ছোটকাল থেকেই শুরু হয়। কেননা তাকে একদম ছোট বয়সেই তার পিতা-মাতা দত্তক দিয়ে দেন। 

পল জবস ও ক্লারা জবস দত্তক নেয়ার পরেই তার নাম রাখা হয় স্টিভেন পল জবস। তবে এ দত্তক দেয়ার বিষয়টি কিন্তু স্টিভ জব শুরুতে জানতেন না। তিনি এই সত্যটি ২৭ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো জানতে পারেন। 

ফিরে আসি স্টিভ জবসের ছোটবেলায়। দত্তক নেয়ার পর স্টিভ জবস তার নতুন পরিবারের সাথে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউ এলাকায় বসবাস করতে শুরু করেন৷ 

স্টিভ জবসের শিক্ষাজীবন 

খুব ছোট বয়সে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্টিভ জবসের যে বিষয়টি সবার নজর কাড়ে তা হলো তার অসাধারণ বুদ্ধি ও দক্ষতা। স্টিভ জবস গতানুগতিক পড়াশোনার প্রতি সেভাবে ঝোঁক প্রকাশ করতেননা। বরং ইনোভেশন বা ক্রিয়েটিভিটি রয়েছে এমন বিষয়গুলোই তাকে আকর্ষণ করতো।

তবে সেসময় তার জীবনে একটি বিষয়ের অভাব ছিলো এবং সেটি হলো সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব। কোনো নির্দেশনা বা সাহায্য না পেলে মানুষ যেমন দিগবিদিক শূন্য হয়ে ছুটতে থাকে, স্টিভের অবস্থাও হয়েছিলো এমনই। কারণ কেউ তাকে বলে দেয়নি যে তার জন্য কোন ধরণের পড়াশোনা করা ভালো হবে। তাই নিজের শিক্ষাজীবন নিয়ে স্টিভ জবস যথেষ্টই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন, শুধুমাত্র নিজের ভালোলাগার জায়গাটুকু খুঁজে পেতে। 

হাইস্কুলের গন্ডি পার হওয়ার পর স্টিভ জবস পোর্টল্যান্ডে অবস্থিত রিড কলেজে ভর্তি হন। তার সেখানেও মন টেকেনি, তাই তিনি কলেজ ড্রপ আউট করেন। তারপরের বছর দেড়েক তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখেন ক্রিয়েটিভ ক্লাসের প্রতি। 

স্টিভ জবস

স্টিভ জবস কিভাবে অ্যাপলের যাত্রা শুরু করেছিলেন? 

এবার আমরা আজকের লেখার টার্নিং পয়েন্টে চলে এসেছি। আপনারা সবাই জানেন, স্টিভ জবসের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো এই অ্যাপলই। তাই তিনি কিভাবে অ্যাপলের যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা সবার জানা থাকা প্রয়োজন৷ 

স্টিভ জবস যখন হোমস্টিড হাইস্কুলের ছাত্র, তখনই তার পরিচয় হয় অ্যাপলের আরেকজন ফাউন্ডার বা প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ওজনিয়াকের সাথে। স্টিভ ওজনিয়াক সেসময় ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার স্টুডেন্ট ছিলেন। তাদের পরিচয় হওয়ার গল্পটিও বেশ মজার। জবস ও ওজনিয়াক দু’জনেরই ইলেকট্রনিকস নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। মূলত এই আগ্রহই তাদের পরিচয় আরো গভীর করে তোলে। 

তারপর ১৯৭৪ সালে স্টিভ জবস একটি ভিডিও ডিজাইন করা  শুরু করেন, তবে তার কিছুদিন পরই তাকে সেটি ছেড়ে আসতে হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে মাত্র ২১ বছরের স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াক সাহস করে জবসের বাড়ির গ্যারেজে অ্যাপল কম্পিউটার নামক প্রথম ভেনচার চালু করেন৷ তারা তাদের নিজেদের জিনিসপত্র বিক্রি করে এই ভেনচারের মূলধন যোগাড় করেছিলেন। ভেবে দেখুন তো, ওই সময়ে এত কম বয়সে এত বড় সাহসের কাজ কয়জন করতে পারে? 

কিন্তু স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াক পেরেছিলেন৷ তাদের এই অ্যাপল কম্পিউটারে ওজনিয়াক কম্পিউটার রিলেটেড কাজ এবং জবস কম্পিউটারের মার্কেটিংয়ের কাজগুলো করতেন৷ 

স্টিভ জবসের ভেনচারের প্রথম কম্পিউটারের মডেলের নাম ছিলো অ্যাপল ওয়ান৷ তারপর দ্বিতীয় মডেল অ্যাপল টু আসার পর অ্যাপল কম্পিউটারের সেল প্রায় ৭০০ শতাংশ বেড়ে যায়।

স্টিভ জবস কেন অ্যাপল ছেড়ে দিয়েছিলেন? 

যদি আপনারা ভেবে থাকেন স্টিভ জবসের ক্যারিয়ার সব সময় তুঙ্গে ছিল, তাহলে আপনারা ভুল ভাবছেন। অ্যাপলের কম্পিউটারগুলো শুরুর দিকে প্রচুর সেল হলেও পরবর্তীতে ডিজাইনজনিত সমস্যার কারণে কাস্টমারদের কাছ থেকে ক্রমাগত ভাবে নেগেটিভ রিভিউ আসতে থাকে। 

পাশাপাশি এ সময় দেখা যায় IBM (আইবিএম) নামের প্রতিষ্ঠানের পার্সোনাল কম্পিউটারগুলোর সেল অ্যাপলের কম্পিউটারের চাইতে বেড়ে যেতে থাকে। এ সময় অ্যাপল কোম্পানি যেমন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়, একই সাথে স্টিভ জবসের মনে হতে থাকে অ্যাপলে তার পর্যাপ্ত ভ্যালু দেয়া হচ্ছে না। তার ওপর বিভিন্ন চাপ আসতে থাকে। এর ফলস্বরূপ ১৯৮৫ সালে তিনি অ্যাপল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

কিভাবে অ্যাপল আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে? 

অ্যাপল ছেড়ে দেয়ার পর ১৯৮৫ সালেই স্টিভ জবস নেক্সট নামের আরেকটি ভেনচার শুরু করেন৷ পরবর্তীতে অ্যাপল এই কোম্পানিকে কিনে নেয়। তারপর ১৯৯৭ সালে স্টিভ জবস অ্যাপলের সিইও হিসেবে পুনরায় ফিরে আসেন। এটি নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, তার এই ফিরে আসার পরেই মূলত অ্যাপল এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেসময় তার নেতৃত্বে অ্যাপলে বিভিন্ন নতুন নতুন গ্যাজেট যেমনঃ আইপড, আইফোন কিংবা ম্যাকবুক এয়ার ইত্যাদির আগমন ঘটে। এগুলোর উন্নত কোয়ালিটি, বেটার মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজি ও মনোমুগ্ধকর ডিজাইনের ফলে এগুলো জয় করে নেয় কোটি কোটি মানুষের মন। শুধুমাত্র সে দেশে নয়, বরং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অ্যাপলের জয়জয়কার। 

তারপর যত দিন যায়, অ্যাপলের গন্ডি বাড়তে থাকে৷ তারপর বিখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিনে আরো ৫০০ টি কোম্পানিকে পেছনে ফেলে আমেরিকার সবচেয়ে অ্যাডমায়ার্ড কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি পায় অ্যাপল। 

Read More

ল্যারি পেজ – হার না মানা এক যোদ্ধা

স্টিভ জবসের আরো সাফল্য 

অ্যাপলের পাশাপাশি স্টিভ জবস ১৯৮৬ সালে পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর যাত্রা শুরু করেন। তিনি এই স্টুডিওতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করেন। তার এই ঝুঁকি সফলও হয়েছিলো। এই স্টুডিও থেকে ফাইন্ডিং নেমো, টয়স্টোরির মতো অসাধারণ সব ছবি প্রোডিউস হয়। এই স্টুডিওর জনপ্রিয়তা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও পিক্সার স্টুডিওর সাথে একত্রিত হয়। 

ক্যান্সারের সাথে স্টিভ জবসের লড়াই 

স্টিভ জবসের জীবনের অন্যতম বড় লড়াই ছিলো ক্যান্সারের সাথে। ২০০৩ সালে তার একটি বিরল ধরণের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তবে এই রোগও স্টিভ জবসকে কাবু করতে পারেনি। তিনি ঠিকই দক্ষতার সাথে তার স্বপ্নের ভেনচার অ্যাপলের জন্য কাজ করে গেছেন। একারণে তিনি অসুস্থ থাকলেও অ্যাপলের জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকুও। 

২০০৪ সালে তার ক্যান্সারের অপারেশন সফল হয়। তবে দুঃখজনক ঘটনা এই যে, তার দেহে পুনরায় এই ক্যান্সার শনাক্ত হয়। তারপর ২০১১ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখে তিনি ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। 

শেষ কথা

আশা করি স্টিভ জবসের জীবনকাহিনী থেকে আপনারা অনেকটুকুই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন জীবনের প্রতিটিক্ষেত্রে লড়াই করে যাওয়ার। আমি বিশ্বাস করি এই লেখাটি থেকে আপনারা অনেককিছু শিখেছেন। 

স্টিভ জবস ছিলেন একজন প্রকৃত যোদ্ধা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যর্থতা থেকেই ধীরে ধীরে সফলতার সূচনা হয়। তিনি তার জীবনে অনেকবারই ভেঙে পড়েছেন, তার জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলোর পর উঠে দাঁড়ানোর শক্তিই থাকেনা। যেমনঃ তিনি যখন অ্যাপল ছেড়ে দিয়েছিলেন, অত বড় একটি ঘটনার পরেও তিনি মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং পরবর্তীতে তার হাত ধরেই কিন্তু অ্যাপল আজ এতদূর এসেছে। 

তিনি তার জীবনে ঝুঁকি নিতে দ্বিধাবোধ করেননি এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধৈর্য্যশীল থেকেছেন। এমনকি তিনি যখন ক্যান্সারের রোগী, তখনও তিনি তার কাজ থেকে দূরে থাকেননি। তাই স্টিভ জবস আমার চোখে একজন যুদ্ধজয়ী সৈনিক। 

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজ থেকে

Leave a Comment