একটি সময় ছিল যখন গাড়ি কেবলমাত্র সমাজের ধনী ব্যক্তিদেরই কেনার সামর্থ্য ছিলো। তখন মধ্যবিত্ত মানুষেরা চাইলেও নিজেদের একটি গাড়ির স্বপ্ন পূরণ করতে পারতেন না। তবে একজন মানুষের অসামান্য অবদানের ফলে অটোমোবাইল শিল্পের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়, যার ফলে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরাও নিজেদের একটি গাড়ি থাকার স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হয়। আপনারা কি বলতে পারেন অটোমোবাইল শিল্পের এই বিপ্লবের সূচনা কার হাত ধরে হয়েছিল? আমি বলে দিচ্ছি, হেনরি ফোর্ড এর হাত ধরে।
আপনারা নিশ্চয়ই ফোর্ড মটরস এর নাম শুনেছেন। হেনরি ফোর্ড হলেন এই ফোর্ড মটরস কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। হেনরি ফোর্ড বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ধনী শিল্পপতি, যিনি অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে এমনভাবে অবদান রেখেছেন, যাতে করে তার প্রতিষ্ঠান ফোর্ড মটরস হয়ে উঠেছিলো বিশ্বের প্রথম ও একইসাথে বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
তবে হেনরি ফোর্ডের পুরো জীবন কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। তিনি ছিলেন সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে। তিনি যখন তার এই সাধারণ পরিচয় থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার লড়াই করেছিলেন, তখন তাঁকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল অনেক বড় বড় যুদ্ধ ও চ্যালেঞ্জের। তারপর সে চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করার পরেই তিনি তার উদ্যোক্তা জীবনে সফল হতে পেরেছিলেন। আজকের লেখায় আপনাদেরকে বিস্তারিতভাবে জানাবো হেনরি ফোর্ড এর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত।
হেনরি ফোর্ডের ছোটকাল ও শিক্ষাজীবন
চলুন লেখার শুরুতেই একটু জেনে নেয়া যাক হেনরি ফোর্ডের ছোটকাল ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখে। তার জন্ম হয়েছিল আমেরিকার মিশিগান নামক স্থানে। তার পিতার নাম উইলিয়াম ফোর্ড এবং মাতার নাম মেরি ফোর্ড। তার পিতা ও মাতা দুজনেই কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মূলত এই কৃষিকাজ থেকেই তাদের মূল উপার্জন আসতো। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে হেনরি ফোর্ড ছিলেন সবচাইতে চঞ্চল।
হেনরি ফোর্ডকে তার মা-বাবা কিন্তু স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তবে অতিরিক্ত চঞ্চল স্বভাবের হওয়ায় এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা থাকায় গতানুগতিক পড়াশোনা তাকে কখনোই সেভাবে টানতো না। তাই তাকে স্কুল থেকে সাসপেন্ড করে দেয়া হয়।
ছোটকাল থেকেই বিভিন্ন যন্ত্রপাতির প্রতি হেনরি ফোর্ড এর একটি আলাদা আগ্রহ কাজ করতো। তার ছোটকালের একটি ঘটনা সবার মধ্যে বেশ প্রচলিত। সেটি হল ফোর্ডের বাবা তাকে একবার একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। সেই ঘড়ি হাতে পড়ার বদলে তিনি ঘড়িটি পুরো খুলে আবার জোড়া লাগিয়ে ফেলেন। এখানে কিন্তু তিনি থেমে যাননি। বরং পরবর্তীতে তার আশেপাশের অনেক মানুষের ঘড়ি তিনি মেরামত করে দিতেন।
এরই মধ্যে তার জীবনে নেমে আসে একটি দুর্ঘটনা। ১৮৭৬ সালে তার মা মারা যাওয়ার পর তিনি তার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলেন। সেইসাথে তিনি সিদ্ধান্ত নেন তার বাবা-মা’র মত কৃষিকাজ করে তিনি জীবন অতিবাহিত করবেন না।
যেই ভাবা সেই কাজ! ১৮৭৯ সালে তিনি তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এবং ডেট্রয়েট নামক জায়গায় জেমস এফ ফ্লাওয়ার এন্ড ব্রাদার্স নামক একটি কোম্পানিতে একজন ইন্টার্ন মেকানিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। ওই যে একটু আগেই বলেছি যন্ত্রপাতির প্রতি ফোর্ডের ভালোবাসা প্রবল ছিল, সেই ভালবাসা থেকে কিন্তু তিনি যন্ত্রপাতি নিয়ে আরো ভালোমতো কাজ করা শুরু করেন।
তারপর সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর ১৮৮২ সালে ফোর্ডের মনে হয় তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে কিন্তু তিনি ডেট্রয়েটের ড্রাই ডক নামক প্রতিষ্ঠান সফলতার সাথে কাজ করেছিলেন।
হেনরি ফোর্ড এর কর্মজীবন কিভাবে শুরু হয়েছিল?
১৮৮২ সালে হেনরি ফোর্ড তার নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন এবং তারপর তার বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য সহযোগিতা করতে শুরু করেন। তবে আপনারা যদি ভেবে থাকেন শুধুমাত্র কৃষি কাজে সহযোগিতা করার জন্যই তিনি বাড়ি ফিরে এসেছিলেন, তাহলে কিন্তু ভুল ভাবছেন।
যেহেতু হেনরি ফোর্ড আগে দুটো প্রতিষ্ঠান মেকানিক হিসেবে কাজ করেছেন, তাই এই সেক্টরের প্রতি তার আগে থেকেই প্যাশন জন্মে গিয়েছিল। তবে তিনি সেটুকু শিখে থেমে যেতে চাননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন বাড়ি ফিরে এসে ওয়েস্টিংহাউজের পোর্টেবল স্টিম ইঞ্জিন কিভাবে পরিচালনা করা হয় সে কৌশল শিখবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি জোরেশোরে কাজ করা শুরু করেছিলেন। তার দক্ষতা ও ডেডিকেশন দেখে ওয়েস্টিংহাউস কর্তৃপক্ষ কিন্তু তাকে ডেকে নিয়ে সেখানে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল।
হেনরি ফোর্ডের ক্যারিয়ারের নতুন মোড়
হেনরি ফোর্ডের অনেকগুলো অসাধারণ গুণের মধ্যে অন্যতম গুণ ছিলো তিনি যেখানেই কাজ করতেন না কেন, পুরোটুকু ডেডিকেশন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করতেন। সেই সাথে সবসময় তার চেষ্টা ছিল নতুন কিছু শেখার। একই সাথে তিনি সবসময় চেষ্টা করতেন নিজের কারিগরি দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু ইনোভেট করার। অর্থাৎ গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কোনো কিছুতে নতুনত্ব আনতে তিনি খুবই ভালবাসতেন। এ কারণে তিনি যেখানেই যেতেন, নতুন নতুন কাজের সুযোগ পেতেন।
১৮৯১ সালে এডিসন ইলেকট্রিক ইলুমিনাটিং কম্পানি নামক একটি প্রতিষ্ঠান তাকে নাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেয়। সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই মূলত তিনি তড়িৎকৌশল এর বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক একদম হাতে কলমে ও গভীরভাবে শেখার সুযোগ পান। ওই প্রতিষ্ঠানটিতে তার কাজের মান এতই ভালো ছিল, যে মাত্র চার বছরেই তিনি নাইট ইঞ্জিনিয়ার থেকে হেড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রমোশন পেয়েছিলেন।
তবে ওইযে, হেনরি ফোর্ড সবসময় চাইবেন গতানুগতিক ধারার বাইরে যেতে! তাই তিনি কিন্তু এডিসন ইলেকট্রিক ইলুমিনাটিং কোম্পানিতে আর কাজ কন্টিনিউ করতে চাননি। বরং তিনি নিজের মতো কাজ করার জন্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অটোমোবাইল সেক্টরে কাজ করা শুরু করতে চেয়েছিলেন।
বলে রাখা ভাল, তিনি কিন্তু খুব বড় পরিসরে অটোমোবাইল সেক্টরে কাজ করার শুরু করেননি। বরং তাদের কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে তার প্রথম উদ্ভাবন ছিল সাইকেলের মতো দেখতে একটি চার চাকা বিশিষ্ট যান। এই যানটির পেছনের দুটো চাকা সাধারণ সাইকেলের মতো হলেও সামনের দুটো চাকাতে স্পিড কন্ট্রোল করার জন্য অটোমেশন সিস্টেম প্রয়োগ করা হয়েছিল। তিনি তাঁর তৈরী করা এই উদ্ভাবন টির নাম দিয়েছিলেন কোয়ার্ডি সাইকেল।
হেনরি ফোর্ড বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনকে দেখে সব সময় অনুপ্রাণিত হতেন নতুন কিছু উদ্ভাবন করার। এ কারণে তিনি যখন কোয়ার্ডি সাইকেল তৈরি করেন তখন সেই সাইকেলটি নিয়ে তিনি টমাস আলভা এডিসনের সাথে দেখা করেছিলেন। এডিসন তার এই উদ্ভাবন দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন এবং তাকে অটোমোবাইল সেক্টর নিয়ে আরও কাজ করতে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন। বলা যেতে পারে, এডিসনের এই উৎসাহটুকুই হেনরি ফোর্ডকে অনুপ্রাণিত করেছিল নিজের প্যাশন নিয়ে আরো এগিয়ে যাওয়ার।
এরপর হেনরি ফর্ড পূর্ণোদ্যমে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন নিজের উদ্ভাবনকৃত যান কোয়ার্ডি সাইকেলকে আরো উন্নত ও অত্যাধুনিক করে তুলতে। ১৮৯৮ সালে তিনি কোয়ার্ডি সাইকেলের চাইতেও আরো একটি উন্নত, নিরাপদ ও আধুনিক ট্রান্সপোর্ট তৈরি করে ফেলেন। তখন ফোর্ডের মনে আত্মবিশ্বাস তৈরি হতে থাকে যে তিনি চাইলে নিজের একটি কোম্পানি ওপেন করতে পারেন। তবে তখনো তিনি এডিসন কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। পুরোপুরি ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৯৯ সালে ওই কোম্পানির চাকরি থেকে রিজাইন করেন। সেই একই বছর হেনরি ফোর্ড তার নিজের প্রতিষ্ঠান ডিট্রয়েট অটোমোবাইল কোম্পানি চালু করেন।
তবে দুঃখের কথা এই যে, তার প্রতিষ্ঠানের তৈরি গাড়িগুলো সেসময় মার্কেটে কত বেশি হাইপ তৈরি করতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ তিনি তার ওই বিজনেস চালু রাখতে পারেননি।
হার না মানা হেনরি ফোর্ডের ক্যারিয়ারের পরের অংশ
আমরা সাধারণত কোন ব্যবসা শুরু করে যদি আশানুরূপ লাভ করতে না পারি, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে অন্য কিছু শুরু করার চিন্তা করি। তবে হেনরি ফোর্ড কিন্তু এমন মানুষ ছিলেন না।
যখন তিনি তার প্রথম ব্যবসা থেকে আশানুরূপ সাফল্য পাননি, তখন তিনি হাল না ছেড়ে দিয়ে আবার কাজ করতে শুরু করেন। সে সময় তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের নজর কেড়ে নিতে পারে এমন গাড়ির মডেল তৈরি করা। এক বছরের মধ্যেই তিনি ২৬ হর্সপাওয়ার ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটি গাড়ি তৈরি করেন, যেটি পরবর্তীতে ১৯০১ সালের অক্টোবরে অফিশিয়ালি তৈরি করার ব্যাপারে সবাইকে জানানো হয়।
এসময় তিনি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান ডেট্রয়েট অটোমোবাইল কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে হেনরি ফোর্ড কোম্পানি হিসেবে নামকরণ করেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো এসময়ও কিন্তু তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেননি। তার ওই কোম্পানিটি পার্টনারশীপ কোম্পানী ছিল, সেসময় কিছু সমস্যার কারণে হেনরি ফোর্ড এ কোম্পানি থেকে সরে যান। যার ফলস্বরূপ কোম্পানির নাম পরিবর্তন হয়ে ক্যাডিলাক অটোমোবাইল কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
এ সময় হেনরি ফোর্ড কিন্তু বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো তিনি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু সে কঠিন সময়ে তিনি তার সবসময়ের অনুপ্রেরণা টমাস আলভা এডিসনের কথা মনে করেন, যিনি নিজেও সফল হওয়ার আগে অনেকবার ব্যর্থতার শিকার হয়েছিলেন। তখন হেনরি ফোর্ড আবার কাজের উদ্যম ফিরে পান এবং তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা শুরু করেন।
হেনরি ফোর্ডের ক্যারিয়ারের পরের প্রজেক্টে ছিল রেসিং কার তৈরি করা। তার তৈরি করা রেসিং কারের মধ্যে একটি রেসিং কার মডেল সবার মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল অল্প সময়েই। আপনারা হয়তো 999 নামক রেসিং কার মডেলের কথা অনেক শুনেছেন। এই রেসিং কার তৈরি করেছিলেন হেনরি ফোর্ড নিজে।
হেনরি ফোর্ডের সাফল্যের অগ্রযাত্রা
হেনরি ফোর্ডের ক্যারিয়ারের সাফল্য কিন্তু শুরু হয়েছিল রেসিং কারের মাধ্যমেই। ১৯০৩ সালে ফোর্ড মোটর কোম্পানী ছিলো হেনরি ফোর্ডের প্রতিষ্ঠা করা দ্বিতীয় অটোমোবাইল কোম্পানি। তবে এই কোম্পানিতে তিনি একা ছিলেন না, বরং এখানে ইনভেস্ট করেছিলেন বড় বড় কয়েকজন উদ্যোক্তা। একই সময়ে তার তৈরি করা 999 মডেলের ড্রেসিং কারটি ব্যবহার করে বহু মানুষ বিভিন্ন রেসিং কমপিটিশনে অংশ নেয়। ফলস্বরূপ এই রেসিং কারের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় অনেক অংশে। সেইসাথে ফোর্ড মোটর কোম্পানির সুনাম ও সাফল্য ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে।
তারপর ১৯০৮ সালে ফোর্ড মোটর কোম্পানির মাধ্যমে “টি” নামক একটি গাড়ির মডেল ম্যানুফ্যাকচার করা শুরু হয়। এই গাড়ির মডেল এর বিশেষত্ব ছিল এখানে বামপাশের চাকার সাথে স্টিয়ারিং কানেক্টেড ছিল। এর আগে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে এমন মডেলের কোন গাড়ি তৈরি হয়নি।
পাশাপাশি এই বিশেষ মডেলের গাড়িটি চালানো ছিল অন্যান্য মডেলের তুলনায় অনেক সহজ। সেই সাথে এই গাড়ির মূল্য ছিল অন্যান্য এলিট ব্র্যান্ডের গাড়ি গুলোর তুলনায় অনেক কম। একই সাথে এই গাড়িটিতে কোন সমস্যা হলে তা মেরামত করানোতেও খুব বেশি বেগ পেতে হতো না।
তাই খুব দ্রুত এই মডেলটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। বিশেষ করে তখনকার সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা গাড়ি কেনার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না, তারাও এই মডেলের গাড়িটি কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করে। মোটকথা হেনরি ফোর্ডের ডিজাইন করা এই গাড়িটি অটোমোবাইল শিল্পে বিপ্লব তৈরি করে দেয়।
এই মডেলকে অনুকরণ করে তখন অন্য অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোও এভাবে গাড়ি তৈরি করা শুরু করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, হেনরি ফোর্ডের কোম্পানিকে কিন্তু কোন অটোমোবাইল কোম্পানি টপকাতে পারেনি। বরং বাজারে এই “টি” মডেলের গাড়িটির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ১৯১৮ সালের একটি স্ট্যাটিসটিকস থেকে জানা যায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রে যতগুলো গাড়ি ছিল তার অর্ধেকই নাকি ছিল হেনরি ফোর্ডের উদ্ভাবনকৃত গাড়ির মডেল “টি”।
তবে হ্যাঁ, এখানেও একটি কিন্তু ছিল। “দিন সবসময় সমান যায় না “-এ কথাটি হেনরি ফোর্ডের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি রকমের সত্য ছিল। বেশ অনেকগুলো বছর তার তৈরি করা গাড়ির মডেল “টি” পুরো মার্কেটে দাপিয়ে বেড়ালেও ১৯২০ এর দিকে এর চাহিদা কমতে শুরু করে।তখন ফোর্ড মোটরস কোম্পানি মার্কেটে লঞ্চ করে “এ” নামক আরেকটি নতুন মডেলের গাড়ি। কয়েক বছর এই গাড়িটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
সেসময়ে হেনরি ফোর্ড ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তার ফোর্ড মোটর কোম্পানি হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় অটোমোবাইল কোম্পানি। তার কোম্পানির শুধুমাত্র যে ব্যবসাসফল ছিল তাই নয়, বরং কোম্পানির শ্রমিক ও প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে হেনরি ফোর্ড ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ। কারণ তিনি কখনোই তার কোম্পানিতে কাজ করা মানুষকে বেতন নিয়ে ঠকাননি। তিনি তার শ্রমিকদের পাঁচ ডলার মজুরি দিতেন, যা সেসময় অন্য কোনো কোম্পানি দিতোনা। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের জন্য বিভিন্ন ফাণ্ড তৈরি করে রেখেছিলেন।
তার কোম্পানি শুধুমাত্র কিন্তু গাড়ি তৈরিতে থেমেছিল না। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মার্কিন আর্মিদের জন্য বিমান, জিপ, ট্যাংক ইত্যাদি সাপ্লাই দেওয়ার জন্যও এই কোম্পানির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
Read More
ইউটিউব মার্কেটিং করে ব্যবসার সেল বাড়ান কয়েকগুণ! YouTube Marketing Most Effective Guideline 2023
হেনরি ফোর্ডের অর্জন
অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে হেনরি ফোর্ডের অসামান্য অবদানের কারণে বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম গাড়ি ম্যানুফ্যাকচারিং দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সুপরিচিত। তার অবদানের পুরস্কার স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সার্ভিস একটি বিশেষ স্ট্যাম্পেরও প্রচলন করেছিল।
তিনি তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অনেকগুলো পুরস্কার। যেমন: তিনি ১৯২৮ সালে ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউটস থেকে ইলিয়ট ক্রেসন পদকটি প্রাপ্ত হন। এছাড়াও ১৯৩৮ সালে নাজি জার্মান গ্র্যান্ড ক্রসের কাছ থেকে জার্মান ঈগল মেডেলও অর্জন করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও তাঁর পাওয়া পুরস্কারের তালিকায় রয়েছে অটোমেটিভ হল অব ফেম পুরস্কার, মোটর স্পোর্টস হল অব ফেইম আমেরিকা পুরস্কার, ইউএস বিজনেস হল অফ ফেইম পুরস্কার ইত্যাদি।
শুধুমাত্র অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতেই নয়, আরো বিভিন্ন বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল। আপনারা হয়তো জেনে অবাক হবেন, হেনরি ফোর্ডের সর্বমোট আবিষ্কারের পেটেন্ট সংখ্যা ১৬১ টি! তিনি একবার একটি গাড়ি তৈরি করেছিলেন,যে গাড়িটি সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়েছিল বিশেষ এক ধরনের প্লাস্টিকের সাহায্যে। অন্যান্য গাড়ির গ্যাস দিয়ে চালাতে হলেও এ গাড়িটি চালাতে হতো ইথানল দিয়ে। শুধু তাই নয় ইস্পাতের তৈরি গাড়ির চাইতে এই গাড়ির ওজন ছিল ৬০ ভাগেরও কম। তবে প্লাস্টিকের গাড়ি বলে এটিকে আবার দুর্বল ভেবে বসবেন না। কারণ অন্যান্য গাড়ির চাইতে এই গাড়িটি ১০ গুণেরও বেশি আঘাত সহ্য করতে পারতো।
হেনরি ফোর্ডের আরেকটি দক্ষতা ছিল, যা অনেকেরই অজানা। তিনি কিন্তু লেখালেখিতেও সমানভাবে দক্ষ ছিলেন। দ্যা কেস এগেইন্সট দ্যা লিটল হোয়াইট স্লেভার নামে তিনি একটি বই লিখেছিলেন, যা মূলত ধূমপান করার বাজে প্রভাব গুলো নিয়ে লেখা হয়েছিল। শুধু তাই নয় মাই লাইফ মাই ওয়ার্ক নামে তার একটি আত্মজীবনীও রয়েছে।
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে তার ছিলো সমান আগ্রহ। তার প্রতিষ্ঠা করা ফোর্ড ফাউন্ডেশন এখনো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছে।
পারিবারিক জীবন
হেনরি ফোর্ডের ক্যারিয়ারের সাফল্যের কথা তো জানলেন, চলুন এবার তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। হেনরি ফোর্ডের স্ত্রীর নাম ক্লারা জায়েন্ট। ১৮৮৮ সালের এপ্রিলে তারা বিয়ে করেছিলেন। ১৮৯৩ সালে তাদের একমাত্র সন্তান এডসেল ফোর্ড জন্মগ্রহণ করেন।
শেষ কথা
১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে আমেরিকার মিশিগানে হেনরি ফোর্ড মৃত্যুবরণ করেন। ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তিনি মারা যান। সে সময় তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
নিজের জীবনের হেনরি ফোর্ড ছিলেন অত্যন্ত সৎ একজন মানুষ। তিনি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতেন। তার জীবন থেকে আমরা শিক্ষা পাই সবসময় নিজের প্যাশন ফলো করার এবং নিজের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাওয়ার। সেই সাথে আমরা আরও শিক্ষা পাই চলার পথে যত বাধাই আসুক না কেন সবসময়ই এগিয়ে যেতে হবে। কারণ বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তবেই সাফল্যের স্বাদ পাওয়া সম্ভব।
আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজ থেকে!