বিল গেটস – কলেজ ড্রপ আউট থেকে বিশ্ব সেরা ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার পেছনের গল্প

“আপনি যদি গরীব ঘরে জন্মান তাহলে
তা আপনার দোষ নয়, কিন্তু আপনি যদি গরীব হয়ে মারা যান তাহলে অবশ্যই আপনার দোষ”

এই উক্তিটি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ধনী ও সফল ব্যক্তিত্ব বিল গেটস এর। তিনি তরুন প্রজন্মকে শিখিয়েছেন কঠোর অধ্যবসায় এবং তপস্যা কিভাবে সাফল্য এনে দিতে পারে। বিল গেটস শুধু তার পরিশ্রম আর ভিন্ন চিন্তাধারার কারণেই খ্যাতি পাননি, বরং তিনি মানব কল্যাণে বিভিন্ন উদ্ভাবনী সৃষ্টিগুলোর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মেরর কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আজকে জানাবো বিল গেটস এর জীবন সম্পর্কে ।

কে এই বিল গেটস ?

বিল গেটস হলেন একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী, সফটওয়্যার ডেভেলপার, বিনিয়োগকারী, জনহিতৈষী এবং একইসাথে মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন। তার বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৪৪ বিলিয়ন ডলার। তিনি ১৯৭০ ৮০ এর দশকে মাইক্রোকম্পিউটার উদ্ভাবনের কারণে গোটা বিশ্বে অন্যতম বিখ্যাত উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষেরা যে Personal Computer বা PC ব্যবহার করে সেটি তৈরী ও প্রত্যেকের কাছে পৌঁছানোর পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে বিল গেটসের। আর এজন্য তাকে “মাইক্রো কম্পিউটার বিপ্লবের জনক” ডাকা হয় ।

বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন

বিল গেটস ২৮ অক্টোবর,১৯৫৫ সালে সিয়াটলে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা একজন সফল অ্যাটর্নি ছিলেন। তার মা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, যিনি একইসাথে তখনকার সময়ের প্রথম আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন।
বাল্যকাল থেকেই স্কুলে বিল গেটস ছিলেন মেধাবী এবং অত্যন্ত সৃজনশীল মানসিকতার। লেকসাইড স্কুল থেকে তার অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শুরু হয়। বিল গেটসের বাবা-মা চেয়েছিলেন যে তিনি আইন পেশায় এগিয়ে যান। কিন্তু বিল এই বিষয়ে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেন নি।
তিনি তার স্কুলে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন। শুধু তাই নয়, মাত্র ১৩ বছর বয়সে, বিল গেটস কম্পিউটার এবং প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করার জন্য অনেক উৎসাহী ছিলেন। তাই বলা যেতে পারে ছোট থেকেই এই মানুষটি ছিলেন মাল্টি ট্যালেন্টেড। শিক্ষাজীবনে, বিল গেটস স্কুলে পড়াশোনার সময় তার বন্ধু পল অ্যালেনকে সাথে নিয়ে কম্পিউটার সেন্টার কর্পোরেশনের একটি সিস্টেমে বাগ খুঁজে বের করার জন্য একসাথে কাজ শুরু করেন।

এছাড়া এ সময় তারা তথ্য বিজ্ঞানের জন্য একটি প্রোগ্রামও লিখেছিলেন যেটি স্কুলে তাদের প্রতিভা সম্পর্কে এক বিষ্ময়ের সৃষ্টি করেছিলো।
বিল গেটসের বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, সে সময় তিনি ২০০০০ ডলারে ট্র্যাফিক অপ্টিমাইজ করার জন্য সফ্টওয়্যার বিক্রি করেছিলেন। মূলত সেখান থেকেই শুরু হয়েছিলো বিল গেটসের সাফল্য এবং বিলিয়ন ডলার সম্পদের যাত্রার সূচনা।

বিল গেটস কিভাবে মাইক্রোসফট কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন?

১৯৭৫ সালের শুরুতে বিল গেটস এবং পল অ্যালেন একটি সফ্টওয়্যার কোম্পানি সহ-প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারা এটির নাম দেন মাইক্রোসফট। প্রাথমিকভাবে, সে সময় তাদের কোম্পামি বিভিন্ন ফার্মে মাইক্রো সফটওয়্যার সরবরাহ করতো। ওই কোম্পানির কাছে সেলস ম্যানেজার নিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না বলে বিল গেটসের মা মেরি ম্যাক্সওয়েল এই পদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

তার কিছুদিন পর পাইরেটেড সফটওয়্যার বাজারে ব্যবহার শুরু হলে কোম্পানিটি প্রবলভাবে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। তবে মাইক্রোসফটের দুই মালিক, বিল গেটস এবং পল অ্যালেন কেউই এতে হাল এতে ছাড়েননি । বরং তারা সেসময় এমএস বেসিক নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন এবং এখান থেকে তারা ৫০০০০ ডলারের মতো লাভ করেন।.

এরপর ১৯৭৯ সালে আমেরিকান বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি IBM , বিশ্বের প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটার বাজারে আনে। তখন তারা মাইক্রোসফটকে তাদের জন্য একটি প্রোগ্রাম তৈরি করার প্রস্তাব দেয়। তবে, সেই সময়ে, মাইক্রোসফটের কাছে কোনো অপারেটিং সফটওয়্যার (ওএস) তৈরির ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তারা তাদের অপারেটিং সফটওয়্যার তৈরির জন্য IBM-এর কাছে অন্য কোম্পানির সুপারিশ করেছিল।

বিল গেটস - কলেজ ড্রপ আউট থেকে বিশ্ব সেরা ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার পেছনের গল্প
তবে তার ঠিক কয়েক মাস পরে মাইক্রোসফট ’86-DOS’ নামে একটি ওএস সিস্টেম ক্রয় করে। তারা এটিকে বৃহৎ পরিসরে রূপ দিতে পুনরায় কাজ করতে শুরু করে। যার ফলে তারা বাজারে নিয়ে আসে ‘MS-DOS’। এটি লঞ্চের পরপরই, মাইক্রোসফট তাদের প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জন্য প্রাথমিক অপারেটিং সফটওয়্যার হিসাবে MS-DOS ব্যবহার করার জন্য IBM কে প্রস্তাব দেয়। আইবিএম অবিলম্বে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে । আর এখান থেকেই শুরু হয় মাইক্রোসফটের এর সাফল্যর সিঁড়িতে পথ চলা।

তারপর আসলে বিল গেটসকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮০ সালে মাইক্রোসফট এবং আইবিএমের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় এবং এটির ফলসরূপ মাইক্রোসফট তখন হয়ে ওঠে মাইক্রোসফট কর্পোরেশন। পরবর্তীকালে, IBM তাদের প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটার MS-DOS এবং অন্যান্য মাইক্রোসফট পণ্য যেমন MS-BASIC, MS-PASCAL এবং MS-COBOL নিয়ে বাজারে ব্যবসা শুরু করে।

এছাড়াও ব্যবসায় আধিপত্য ধরে রাখতে মাইক্রোসফট ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জন্য প্রথম মাউস আবিষ্কার করে এবং উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করে। আর এই উইন্ডোজ লঞ্চ বিল গেটসকে সুখ্যাতি ও প্রাচুর্য তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।

Read More

নিরাপদে পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার করার উপায় জানুন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করুন নিশ্চিন্তে!

কেন বিল গেটস জীবনে এতটা সফল হতে পেরেছেন?

সফলতা মানুষের জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছাত্রজীবনের বেশিরভাগ মানুষ যেখানে প্রাধান্য দেয় পড়াশোনা সেখানে বিল গেটস প্রাধান্য দিয়েছিলেন তার প্যাশনকে। আর একারণেই সফলতা যেন তার কাছেই ধরা দিয়েছে বারবার। প্যাশনের পাশাপাশি তিনি সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে শেখা, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, কঠোর পরিশ্রম এবং টিমওয়ার্ক বিষয়গুলোকেও তিনি অনেক প্রাধান্য দিতেন।
এ কারণেই ১৯৭৫ সালে বিল গেটস তার বন্ধু পল অ্যালেনের সঙ্গে মাইক্রোসফট সহপ্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে বিশ্বের বৃহত্তম ব্যক্তিগত কম্পিউটার সফটওয়্যার সংস্থা হয়ে ওঠে।

তিনি কম্পিউটার নিয়ে এত প্যাশনেট ছিলেন যে তিনি তার স্কুলের জন্য কম্পিউটারের বাগ খুঁজে বের করার জন্য কাজ করতেন। কতজন মানুষ নিজের প্যশনকে এত গুরুত্ব দেয় বলুনতো? আমরা যেখানে পড়াশোনা ও চাকরির পিছে দৌড়ে বেড়াই, সেখানে বিল গেটস বরাবরই নিজের প্যাশনকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

১৯৮০ সালের দিকে তাদের স্টার্টআপ মাইক্রোসফটের বিক্রয় এবং বাজেটে এত রিস্ক ছিল যে সে সময় তারা কোনো সেলসম্যানও নিয়োগ দিতে পারেননি। এই সময়টাতেও হাল ছাড়েননি বিল গেটস। বরং তিনি মাইক্রোসফটে কাজ করার জন্য হার্ভার্ডে পড়াশোনা থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি তিনি তার পণ্য এবং সেবাগুলোর মান উন্নত করার জন্য প্রচুর সময় দিতেন। আর এর মাধ্যমেই তিনি বিশ্বের সবথেকে ধনী ব্যক্তি হবার পাশাপাশি অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তির তকমাটিও নিজের নামের সাথে লাগিয়ে ফেলেন। তাই বলা যেতে পারে নিজের উপর বিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম এবং কোনো কাজে সফল হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্রমাগত লেগে থাকার মানসিকতা – এ তিনটি বিষয়ের কারণেই বিল গেটস আজ এত সফল।

ব্যক্তিগত জীবন

বিল গেটসের ব্যক্তিগত জীবন ছিলো বাকি ৮-১০ জন সাধারণের থেকে অনেক আলাদা । তিনি ১ জানুয়ারী, ১৯৯৪ সালে-এ মেলিন্ডাকে বিয়ে করেন। তাদের  ৩ সন্তান রয়েছে এবং তাদের নাম জেনিফার, ররি এবং ফিবি। তিনি পরিবারসহ ওয়াশিংটনে বসবাস করেন।

গেটস তার পরিবারের সাথে ওয়াশিংটনের বাড়িতে থাকেন, যার মূল্য প্রায় $১২.৫০ মিলিয়ন। বিল গেটসের মোট সম্পদ $১১০ বিলিয়ন (প্রায় ৭.৮৯ লাখ কোটি টাকা)। তবে এত সম্পদশালী এবং সফল ব্যক্তি হবার পরেও ব্যক্তিগত নানা কারণে ২ আগস্ট, ২০২১ এর দিকে বিল-মেলিন্ডা দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়।

তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে জানা যায় যে তিনি টেনিস এবং গলফ খেলতে অনেক পছন্দ করেন। এছাড়া তিনি পেইন্টিং সংগ্রহ করতেও ভালোবাসেন ,তিনি সামুদ্রিক চিত্রকর্ম “লস্ট অন দ্য গ্র্যান্ড ব্যাঙ্কস” এর জন্য ৩০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছিলেন। তবে দুঃখের বিষয় যে তিনি ২০১৬ সালে প্রকাশ করেছিলেন যে তিনি বর্ণান্ধ।

বিল গেটস সম্পর্কে অজানা তথ্য

বিল গেটস সবসময় তার বন্ধুদের সামনে বলতেন যে তিনি ৩০ বছর বয়সে কোটিপতি হবেন এবং ৩১ বছর বয়সে তিনি সত্যিকারের কোটিপতি তকমা তার নামের পাশে লাগিয়েছিলেন। আপনারা জেনে অবাক হবেন এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রতিটি সন্তানের নামে তার সম্পত্তির মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার ন্যস্ত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ এর বাইরে তার সন্তানদের কোনো অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হবে না।

বিল গেটসের অর্জন

বিল গেটস তার ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। যেমন : ন্যাশনাল মেডেল অব টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন ১৯৯২, সিলভার বাফেলো অ্যাওয়ার্ড ২০১০, বাম্বি মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড ২০১৩,
বোয়ার আওয়ার্ড বিজনেস লিডারশিপ ২০১০, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম ২০১৬, ইউটিউব ক্রিয়েটর অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ ইত্যাদি।

তথ্যপ্রযুক্তিতে অসামান্য অবদানের পাশাপাশি তিনি মানব কল্যাণেও এক বিশাল অবদান রেখেছেন। তিনি প্রতি বছর ভারতে আসেন এবং এখানে দরিদ্রদের উন্নতির জন্য কাজ করেন। বিল গেটস অসহায়, দরিদ্র এবং অভাবীদের সাহায্য করার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজের জন্য “জেফারসন পুরস্কার” লাভ করেন। এছাড়াও দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য সমগ্র ভারতে পরিচালিত দাতব্য ফাউন্ডেশনের জন্য ভারত কর্তৃক পদ্মভূষণে ভূষিত হন ২০১০ সালে।

শেষ কথা

আমরা প্রত্যেকে যে পার্সোনাল কম্পিউটার ব্যবহার করি তা সকল মানুষের কাছে পৌঁছানোর পিছনে সবচেয়ে যে মানুষটির বেশি আদান ছিলো, তিনি ছিলেন বিল গেটস। তার কঠোর পরিশ্রম ঈ ব্যবসায়িক বুদ্ধির ফলে গোটা বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশে যোগ হয়েছে নতুন এক মাত্রা। আশাকরি বিল গেটস এর জীবন কাহিনী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আপনারা নিজেদের জীবনে কাজে লাগাবেন।

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজ থেকে!

Leave a Comment