অবসর সময় কাটানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়া যেন আমাদের অন্যতম প্রিয় সঙ্গী। প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে ফেসবুকে স্ক্রল করে সবার লাইফ আপডেট দেখতে, ইনস্টাগ্রামে রিলস দেখতে কিংবা টুইটারে প্রিয় সেলিব্রেটির করা টুইট দেখতে আমাদের কিন্তু বেশ ভালোই লাগে। তবে অনেকেই রয়েছেন যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জানেন না। ফলে তারা এমন কিছু কাজ করে ফেলেন, যেগুলো তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। আজকের লেখায় আপনাদের জানাবো সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আপনারা যে কাজগুলো করতে পারেন এবং যে কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকতে পারেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা কি আমাদের জন্য নিরাপদ?
সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে বর্তমানে আমরা অবসর সময়ে বিনোদনের এক দারুণ খোরাক পেয়েছি। সেই সাথে সোশ্যাল মিডিয়া সবার সাথে যোগাযোগ করার কঠিন প্রক্রিয়াকেও অনেক সহজ করে দিয়েছে। যেমন: আমরা এখন চাইলে দূর দেশে থাকা কোনো আত্মীয় কিংবা বন্ধুর সাথে চট করে ভিডিও কলে কথা বলে নিতে পারি, আবার চাইলে মেসেজেও তাদের খোঁজ নিতে পারি।
যোগাযোগের পাশাপাশি এখন অনেকেই রয়েছেন যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ব্যবসা সফলভাবে গড়ে তুলছেন এবং পরিবর্তন করছেন নিজেদের ভাগ্যের চাকা। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা কিংবা চাকরির পড়াশোনা করার জন্যেও সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে, সেগুলো থেকে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে উপকৃত হতে পারি।
তবে সব ভালোরই কিন্তু একটি খারাপ দিক থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি সত্য। যদি আপনারা না বুঝে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তাহলে তা বড়সড় বিপদের কারণ হতে পারে। যেমন ধরুন: ইদানিংকালে আপনারা অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার ঘটনা অনেক দেখে থাকবেন। সাধারণত অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার পর হ্যাকাররা সোশ্যাল মিডিয়া ইউজারদের ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দেয় এবং তারা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। কখনো কখনো ইউজারদের অ্যাকাউন্ট থেকে তারা এমন কিছু পোষ্ট করে, যেগুলো ইউজারদের পরিচিত মানুষের সামনে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে পারে।
তবে শুধুমাত্র যে পার্সোনাল অ্যাকাউন্টই হ্যাক হচ্ছে তা নয়, এখন অনেকের বিজনেস বা ব্লগিং পেজও হ্যাক হওয়ার ঘটনা অহরহ শোনা যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, বিজনেস অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে পেইজের নাম বদলে দেয়া হচ্ছে, পেইজের পোস্ট সরিয়ে ফেলা হচ্ছে বা এমন কোনো কন্টেন্ট পোস্ট করা হচ্ছে, সেগুলো ওই পেইজের সাথে কোনভাবেই যায় না।
আবার যাদের ব্লগিং অ্যাকাউন্ট হ্যাক হচ্ছে তারা অভিযোগ করছেন, হ্যাকাররা নাকি তাদের মনিটাইজেশনের এক্সেস নিয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ তারা ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যে টাকা উপার্জন করছেন, তা আর তাদের ব্যাংক একাউন্টে আসছে না। এর পাশাপাশি অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কারো সাথে পরিচয় হওয়ার পর মানুষটির সাথে দেখা করতে গিয়ে তারা বিপদে জড়িয়ে পড়ছেন।
এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন জালিয়াতির শিকার হয়ে বহু মানুষ অভিযোগ করেছেন তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের অ্যাক্সেস চলে গেছে হ্যাকারদের হাতে। আশা করি এখন আপনারা বুঝতে পারছেন, একটু ভুল পদক্ষেপের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার আপনাদের জীবনে ডেকে আনতে পারে বড় ধরনের বিপদ। তাই বলা যেতে পারে চোখ বন্ধ করে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা মোটেও নিরাপদ নয়।
কিভাবে আপনারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন?
আমি জানি, এখন আপনারা অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, “যে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জন্য এত বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা চালানো উচিত হবে কিনা?” এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, না। তবে নিরাপদ রাখার জন্যে কিছু সতর্কতাঃ অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। তাহলে চলুন এবার আপনাদেরকে জানিয়ে দেই কিভাবে আপনারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন সে সম্পর্কে।
১। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে সবসময় নিরাপদ রাখার জন্য প্রথমেই আপনাদের পাসওয়ার্ড যেন স্ট্রং হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য সব কাজে অনেক এফোর্ট দিলেও পাসওয়ার্ডের ব্যাপারে আমরা কেমন যেন অলস হয়ে যাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মোবাইল নাম্বার, জন্মসাল কিংবা নিজেদের নামকেই আমরা পাসওয়ার্ড হিসেবে সেভ করে রেখেছি। এই সহজ পাসওয়ার্ডগুলো হ্যাকাররা চাইলে কয়েক মুহূর্তে হ্যাক করে ফেলতে পারে। তাই নিজের পাসওয়ার্ড অবশ্যই স্ট্রং হতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো কঠিন শব্দ, এলোমেলো লেটার, নাম্বার এবং সিম্বলের কম্বিনেশনে পাসওয়ার্ড সেট করতে পারেন। এক্ষেত্রে পরামর্শ থাকবে-
- লেটারের ক্ষেত্রে সবসময় বড় হাতের ও ছোট হাতের দুই ধরনের লেটার রাখুন
- নাম্বার এর ক্ষেত্রে কখনোই ক্রমিক নাম্বার দেবেন না
- লেটার ও নাম্বারের মাঝে বিভিন্ন সিম্বল ও বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করুন
২। বর্তমানে সব সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখার জন্য টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন নামের একটি অপশন থাকে। টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন অন করা থাকলে যদি অন্য কেউ আপনার অ্যাকাউন্টে লগ ইন করতে চায়, তাহলে আপনার মোবাইল নাম্বার কিংবা ইমেইল অ্যাড্রেসে একটি ইউনিক কোড আসবে, যে কোড ছাড়া আপনার সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ ঢুকতে পারবে না।
বেশিরভাগ মানুষই আলসেমি করে টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন অন করেন না, অথচ এই একটি অপশন অন রাখলেই অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। তাই অবশ্যই টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন অন করে রাখুন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোড রিসিভ করার জন্য মাধ্যম হিসেবে আপনার ফোন নম্বর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোতে অ্যাড করে রাখেন। কারণ এখন চাইলে কিন্তু দুই মিনিটেই ইমেইল অ্যাড্রেস হ্যাক করা যায়। তবে যেহেতু মোবাইল নম্বর হ্যাক করা সম্ভব নয়, তাই এটি অ্যাড করা একদম নিরাপদ।
৩। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিরাপদ থাকার জন্য আরেকটি টিপস হলো প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড ইউজ করা। আমি জানি আমাদের সবার স্বভাব রয়েছে যে একটি পাসওয়ার্ডই আমরা সব অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করি। কিন্তু সত্যি বলতে এ অভ্যাসটি আপনাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের সিকিউরিটি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। তাই কষ্ট করে হলেও আপনার প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, যেমন: ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন কিংবা টুইটারে আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড সেট করুন। তাহলে আপনার অ্যাকাউন্ট থাকবে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।
Read More
জ্যাক মা: বারবার হারতে হারতে সফল হয়েছেন যিনি (Jack Ma Biography in Bangla)
৪। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিরাপদ থাকার জন্য আপনারা সোশ্যাল মিডিয়াতে কখন কী পোস্ট করছেন সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখুন। অনেকেই রয়েছেন যারা কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বা কোথাও ঘুরতে গেলে সাথে সাথেই পাবলিকলি চেক ইন দেন। আপনারা হয়তো জানলে অবাক হবেন, অনেক অসাধু ব্যক্তি রয়েছে যারা এই চেক ইন পোস্ট দেখার জন্য ওত পেতে থাকে। বিশেষ করে যে টুরিস্ট প্লেসগুলো রয়েছে সেগুলোতে যাওয়ার সাথে সাথে পাবলিক পোষ্টের মাধ্যমে চেক ইন দেওয়া মোটেও নিরাপদ নয়। তাই এ অভ্যাসটি থেকে বিরত থাকুন।
৫। ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্ট অথবা ইনস্টাগ্রামে ফলোয়ার লিস্টে কাদেরকে অ্যাড করছেন সেদিকে নজর রাখুন। অনেকসময় আমরা একদম অপরিচিত মানুষদেরকে নিজেদের প্রোফাইলে অ্যাড করে নেই। তারপর দেখা যায় সে মানুষগুলো আমাদের অ্যাকাউন্ট থেকে আমাদের ব্যক্তিগত ইনফরমেশন ও ছবি চুরি করে ফেক অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করার মাধ্যমে আমাদেরকে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। যেমন, এখন অনেকের কাছ থেকে শুনতে পাওয়া যায় যে তাদের নাম ও ছবি দিয়ে ফেক অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করা হয়েছে এবং সে অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বিপদের কথা বলে টাকা চাওয়া হচ্ছে। তাই প্রোফাইলে কখনোই একদম অপরিচিত মানুষজনদের অ্যাড করবেন না। কারণ আপনি বা আমি কেউই জানিনা কার মনে কি আছে!
৬। কখনোই নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ইনফরমেশন সোশ্যাল মিডিয়ার কারো সাথে শেয়ার করবেন না। এমনকি পারলে আপনার ওয়ার্কপ্লেস বা ব্যবসা সম্পর্কে কোন তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখবেন, যদি আপনি নিজের প্রাইভেসি সঠিকভাবে মেনটেইন করতে পারেন, তাহলেই দেখবেন বিপদের আশঙ্কা অনেক কমে গেছে।
শেষ কথা
এটুকুই ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। এই ছোট ছোট সতর্কতাগুলো অবলম্বন করলে আপনারা খুব সহজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন।
আর্টিকেলটি ভালো লাগলে ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজ থেকে!